নূরজাহান বেগমের স্বামী মারা গেছেন এক যুগের বেশি সময় আগে। তারপর ছোট ছোট চার মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে অথই সাগরে পড়েছিলেন তিনি। চারদিকে শুধু অন্ধকার। সেই অন্ধকার ঠেলে অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে বড় করে তোলেন সন্তানগুলোকে। বছর দেড়েক আগে এক আত্মীয়ের সহায়তায় চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের এই নারী সন্তানদের নিয়ে ঢাকার সাভারে চলে আসেন। তার আগেই অবশ্য বিয়ে দেন বড় মেয়েটিকে।
সাভারে এসে দ্বিতীয় মেয়ে সেলিনা (১৯) ও তৃতীয় মেয়ে আকলিমা (১৮) কাজ নেন রানা প্লাজার সাততলার নিউ ওয়েব স্টাইল পোশাক কারখানায়। চাকরি পেয়ে দুই বোন মিলে ছোট বোন আর ভাইটিকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। ঘরভাড়া, সংসার গুছিয়ে সঞ্চয়ও করতে শুরু করেন তাঁরা। কিন্তু সেই সুখ টেকেনি। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মারা গেছেন সেলিনা। আর মাথায় আঘাত পেয়ে আকলিমা এখনো অসুস্থ। গত বছর দুই মেয়ে একসঙ্গে চাকরি পাওয়ায় তাঁদের বেতন আর বোনাসে ওই বারের ঈদে আনন্দ একটু বেশিই ছিল নূরজাহানের ঘরে। কিন্তু এবার তাঁর ঘরে চুলাও জ্বলেনি। গত শুক্রবার ঈদের দিন কান্নায় বুক ভিজিয়ে নূরজাহান বলেন, ‘রানা প্লাজার ভবনের নিচে আমার ঈদও মইরা গেছে।’
সারা দেশে যখন ঈদ আনন্দ, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে বাড়ি ফেরার ভিড়, নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও মানুষ যখন উৎসবমুখর, তখন রানা প্লাজার ভবন ধসে আহত, নিহত আর নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের ঈদ এবার নূরজাহান বেগমের মতোই চোখের জলে কেটেছে।
ঈদের দিন সাভারের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভবনটি ধসে হতাহত আর নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেল। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের সোলায়মান হোসেনের স্ত্রী সবনা বেগম এবার ছোট তিন সন্তান ফোয়ারা (১০), ইব্রাহীম (৬) ও এমরানকে (৩) কিছুই কিনে দিতে পারেননি। কৃষিকাজে ভালো রোজগার না হওয়ায় এই তো কিছুদিন আগে তারা পুরো পরিবার সাভারে চলে আসে। রানা প্লাজা ধসের মাত্র এক মাস আগে সোলায়মান কাজ নেন ভবনটির তিনতলার নিউ ওয়েব বটমে। প্রথম চাকরির বেতনটাও পাননি। তার আগেই গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসে মারা যান তিনি। ধ্বংসস্তূপ থেকে তাঁর মৃতদেহও উদ্ধার করা যায়নি। আর মৃতদেহ না পাওয়ায় কোনো সহায়তাও পাননি সবনা। এবার সবনার ঘরে চুলা জ্বলেনি ঈদের দিনেও। প্রতিবেশীরা শিশুসন্তানগুলোকে তাঁদের ঘরে নিয়ে সেমাই খাইয়েছেন। দুচোখের পানি ফেলতে ফেলতে সবনা বলেন, ‘ভালোর জন্য সাভার আইসা আমার সবই গেল।’
ঈদের দিন অন্যের বাড়িতে চেয়েচিন্তে নাতি আঁখি (৯) আর জয়কে (৫) খাইয়েছেন নানি হাবিয়া বেগম। এরপর বাচ্চা দুটিকে নিয়ে চলে গেছেন ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে। সেখানে বসে চোখের জল মুছে কাটিয়ে দিয়েছেন দিন। অথচ গত বছর ঈদের দিনে মেয়ে শিল্পীর বেতন আর বোনাসের টাকায় কত আনন্দই না ভিড় করেছিল তার ছাপড়াঘরে।
রফিকুল ইসলামের অভাবের সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আনতে তাঁর স্ত্রী বছর খানেক আগে রানা প্লাজার পাঁচতলার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। এবার ধ্বংসস্তূপে অনেক খুঁজেও স্ত্রীর লাশ তিনি পাননি। তিনি জানান, স্ত্রীর মৃতদেহ খুঁজতে তাঁকে নিজের কাজ ছাড়তে হয়েছে। কোনো কাজ এখনো তিনি শুরু করতে পারেননি। তাই এবার ঈদে ছেলেদের কিছু কিনেও দিতে পারেননি।
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান মোল্লা জানান, ‘রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও স্বজনহারাদের সাহায্যের জন্য স্থানীয়ভাবে আমাদের কোনো সুযোগ নেই। সরকার থেকে আমরা কোনো বাড়তি তহবিল পাইনি। এ বিষয়গুলো দেখার কথা বিজিএমইএর।’