মেয়ে মাইসাকে স্কুল গেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আর দেরি না করে মা সোহাগী আক্তার সোজা টিসিবির লাইনে গিয়ে দাঁড়ান। মাইসার স্কুলের কাছেই রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডার জাগরণী সংসদের মাঠে ছিল টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) পণ্যবাহী ট্রাকটি। সোহাগীর সঙ্গে তখন ছোট মেয়ে চার বছরের সাদিয়া। তাকে কোলে নিয়ে যখন লাইনে দাঁড়ান, তখন সকাল প্রায় সোয়া ১০টা। তাঁর সামনে ৬০ জনের মতো নারী। দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত লাইন বেশ খানিকটা এগিয়েছে। ওদিকে বড় মেয়ে মাইসাকে স্কুল থেকে আনার সময় হয়ে গেছে।
বাধ্য হয়ে লাইনের সামনে ও পেছনে থাকা দুই নারীকে নিজের জায়গাটি ধরে রাখার অনুরোধ জানিয়ে সোহাগী আক্তার আবার স্কুলে ফিরে যান। ফিরে এসে আবার লাইনে দাঁড়ান তিনি। দুই মেয়ে তখন লাইনের পাশে খেলছিল। মাইসা দক্ষিণ বাড্ডার ভোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
সোহাগী টিসিবির পণ্য হাতে পান বেলা সোয়া একটার দিকে। তাঁর বাসা বাড্ডার জাগরণী সংসদ মাঠের পাশেই। বাসায় ফেরার পথে তিনি প্রথম আলোকে বললেন, বাইরে জিনিসপত্রের খুব দাম। টিসিবির লাইনে ধকল থাকলেও পণ্য কিনলে সাশ্রয় হয়। আরও জানালেন, তাঁর স্বামী দক্ষিণ বাড্ডায় একটি আসবারের দোকানের কর্মী। বেতন পান ১৫ হাজার টাকা। এই টাকায় কোনোরকমে চারজনের সংসার চলে।
সোহাগী আক্তার শেষ পর্যন্ত টিসিবির পণ্য পেলেও লাইনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে পণ্য পাননি মল্লিকা রানী। তাঁর ছেলে অর্ণব পড়ে শিশু শ্রেণিতে। তিনিও ছেলেকে স্কুলে রেখে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর লাইন ছেড়ে যান ছেলেকে আনতে। কিন্তু লাইনের সামনে ও পেছনে কাউকে বলে যাননি। ফিরে এসে আগের জায়গায় আর দাঁড়াতে পারেননি।
দক্ষিণ বাড্ডায় গতকাল বুধবার টিসিবির পরিবেশক মেসার্স সাথী স্টোর একসঙ্গে ‘প্যাকেজ’ হিসেবে ছয়টি পণ্য (দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি চিনি, দুই কেজি মসুর ডাল, চার কেজি ছোলা, এক কেজি খেজুর ও পাঁচ কেজি পেঁয়াজ) ৮৯০ টাকায় বিক্রি করেছে। এই ছয়টি পণ্য বাজার থেকে কিনতে গেলে খরচ হবে অন্তত ১ হাজার ১৫০ টাকা। সাশ্রয় হয় অন্তত ২৬০ টাকা।
টিসিবির পরিবেশক নবী হোসেন বলেন, ২৫০ জনের জন্য প্যাকেজ ছিল। কিন্তু নারী ও পুরুষ মিলে ৩০ জনের মতো খালি হাতে ফিরে গেছেন।
টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাক কখন আসবে, কোথায় দাঁড়াবে, তা জানতে গতকাল সকাল ১০টা দিকে মিরপুর-১১ নম্বর সেকশনের নান্নু মার্কেট এলাকায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে (উত্তর সিটির ৫ নম্বর ওয়ার্ড) যান পাঁচ নারী। তাঁরা হলেন রহিমা খাতুন, নাজমা বেগম, রাজিয়া আক্তার, রোজিনা বেগম ও হালিমা খাতুন। তাঁদের কেউ বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন, কেউবা বাসায় থেকে সেলাইয়ের কাজ করেন, কেউ গৃহিণী।
এই পাঁচজনকে বলা হয়, ট্রাক প্রথমে কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে আসবে। এরপর নির্ধারিত স্থানে পাঠানো হবে। তবে সেই স্থান কোনটি, তা বলতে পারেননি কার্যালয়ের কর্মীরা। এরপরও তাঁরা ঘণ্টাখানেক সেখানেই অপেক্ষা করেন। কিন্তু ট্রাকের দেখা না পেয়ে মিরপুরের যেসব স্থানে এর আগে টিসিবির ট্রাক পণ্য বিক্রি করত, এ রকম ছয়টি জায়গায় যান। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা আবার কাউন্সিলরের কার্যালয়ের সামনে আসেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সেখানে টিসিবির পণ্য নিয়ে ট্রাক আসে। তবে কার্যালয় থেকে বলে দেওয়া হয়, পণ্য বিক্রি করতে হবে মিরপুর-১১ নম্বর সেকশনের ই ব্লকের বর্ণমালা মডেল স্কুলের সামনে। কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে ওই স্কুলের দূরত্ব দেড় কিলোমিটারের বেশি।
টিসিবির ট্রাকের সন্ধানে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকা এবং বিভিন্ন এলাকায় হেঁটে বেড়ানো ওই পাঁচ নারীর শরীর আর কুলাচ্ছিল না। তাই দুটি রিকশায় ট্রাকের পিছু নেন তাঁরা। টিসিবির ট্রাক বর্ণমালা স্কুলের সামনে পৌঁছানোর পর লাইনেও সবার আগে দাঁড়ালেন তাঁরা। দ্রুতই পণ্য কেনার সুযোগ হয় তাঁদের।
ওই নারীদের একজন রোজিনা বেগম। তিনি থাকেন মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের ই ব্লকে ভাড়া বাসায়। সেলাইয়ের কাজ ও জামায় পাথর বসানোর কাজ করেন তিনি। স্বামী আবদুল আলীম তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী। তাঁদের এক ছেলে, নাম রাব্বি। মিরপুরের দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজের ছাত্র।
রোজিনা প্রথম আলোকে বলেন, দিনে গড়ে ১৫০ টাকা আয় তাঁর। স্বামী মাসে বেতন পান ১৪ হাজার টাকা। খুব কষ্টে দিন চলছে। তিনি বলেন, কষ্ট হলেও ছেলের পড়াশোনা যাতে বন্ধ না হয়, সেই চেষ্টা করেন তাঁরা। সংসারের খরচ বাঁচাতে কষ্ট হলেও টিসিবি থেকে পণ্য কেনেন।
ওই পাঁচ নারীর আরেকজন হালিমা খাতুন। দুই মেয়ে নিয়ে তাঁরা মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বি ব্লকে থাকেন। বড় মেয়ে উম্মে হাবিবা মিরপুর বিজ্ঞান কলেজে পড়েন। ছোট মেয়ে ফাতেমা পড়ে প্রথম শ্রেণিতে।
হালিমার স্বামী খন্দকার হাবিবুর রহমান মিরপুরেই একটি মুদির দোকান চালান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিজেদের দোকান থেকে যে লাভ আসছে, তা দিয়ে সংসার চলছে না।
গতকাল মিরপুরে পণ্য নিয়ে যায় টিসিবির পরিবেশক মেসার্স বাহার এন্টারপ্রাইজ। পরিবেশকের প্রতিনিধি এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ভোর সাড়ে ছয়টায় টিসিবির তেজগাঁওয়ের গুদামে পণ্য নিতে ট্রাকের সিরিয়াল দেওয়া হয়। ট্রাকে পণ্য ওঠানোর সুযোগ আসে বেলা আড়াইটার পর। ওই পণ্য নিয়ে মিরপুর পৌঁছাতেই বিকেল চারটা বেজে যায়। আগের চেয়ে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি ট্রাকে বরাদ্দকৃত পণ্যের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। এ ছাড়া ট্রাকের সংখ্যাও এখন প্রায় দ্বিগুণ।