কালচারাল একাডেমি

সোমেশ্বরীর তীরে সংস্কৃতিচর্চা

প্রায় ৪৪ বছর ধরে কালচারাল একাডেমি মূলত দুটি শাখার মাধ্যমে কাজ করে আসছে। একটি সাংস্কৃতিক শাখা, অন্যটি গবেষণা শাখা।

আঁকাবাঁকা নদী, ছড়া, সারিবদ্ধ পাহাড়, সবুজ বেষ্টিত এক বৈচিত্র্যময় জনপদ নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর। সোমেশ্বরী নদীর দক্ষিণ কূল ঘেঁষে দুর্গাপুর উপজেলার ছোট একটি ইউনিয়নের নাম বিরিশিরি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চায় এক অনন্য প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহে বসবাসরত গারো, হাজং, হদি, কোচ, বানাই, ডালুসহ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিচর্চার ধারা বিকাশে অবদান রেখে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি সূত্র জানায়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৭ সালে স্থাপিত হয়। স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি’। ২০১০ সালে নাম পরিবর্তন করে করা হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি। শান্ত, সুনিবিড় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জনপদ হিসেবে খ্যাত বিরিশিরিতে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিলুপ্তপ্রায় ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, নৃত্য-গীত প্রভৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, নিয়মিত চর্চা, বিভিন্ন উৎসব উদ্‌যাপন, বিকাশ, প্রকাশনা, অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রভৃতির মাধ্যমে জাতীয় সংস্কৃতির মূল স্রোতোধারার সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করে যাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটি এখন সারা দেশের ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পর্যটকেরা এখানে ভিড় জমাচ্ছেন। ৩ দশমিক ২১ একর জায়গাজুড়ে আছে প্রশাসনিক ভবন, আধুনিক অডিটরিয়ামে, জাদুঘর ও সংগ্রহশালা, লাইব্রেরি, মহড়াকক্ষ, বিশ্রামাগার, হোস্টেল, পরিচালকের বাসভবন, পুকুর, বাগান। সম্প্রতি নতুন একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। গণপূর্ত বিভাগের অধীনে প্রস্তাবিত প্রকল্পটিতে মিউজিয়াম, প্রশিক্ষণ ভবন, আদিবাসীর জীবনধারা সম্পর্কিত ম্যুরাল, টেরাকোটা, মুক্তমঞ্চ, প্রধান ফটক, জমি অধিগ্রহণসহ বেশ কিছু উন্নয়নকাজ ধরা হয়েছে। এসব বাস্তবায়িত হলে সংস্কৃতিচর্চা আরও বেগবান হবে।

প্রায় ৪৪ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি মূলত দুটি শাখার মাধ্যমে কাজ করে আসছে। একটি সাংস্কৃতিক শাখা, অন্যটি গবেষণা শাখা। তবে এতে জনবলসংকট, বরাদ্দের অপ্রতুলতাসহ নানা সমস্যাও আছে। প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত জনবলের সংখ্যা ১৭। এর মধ্যে পরিচালকের পদটি এক থেকে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক। বর্তমান পরিচালকের দায়িত্বে আছেন গীতিকার সুজন হাজং। ১১ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী কমিটির পদাধিকারবলে সভাপতি নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক।

প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর হারিয়ে যাওয়া ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাদ্যযন্ত্র, ব্যবহৃত জিনিস সংরক্ষণ ছাড়াও বছরব্যাপী বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। উৎসবের মধ্যে আছে গারো সম্প্রদায়ের ওয়ানগালা, হাজং সম্প্রদায়ের দেউলি উৎসব, কোচ সম্প্রদায়ের বিহু উৎসব, হদি সম্প্রদায়ের বসন্তবর্ত উৎসব, বানাই সম্প্রদায়ের বাস্তুপূজা উৎসব অন্যতম। এসব উৎসবে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ অংশ নেন।

এরই মধ্যে ১১ ডিসেম্বর থেকে হয়ে গেল দুই দিনব্যাপী ওয়ানগালা উৎসব। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও অলংকার পরে একাডেমির প্রাঙ্গণে সমবেত হন গারো নারী-পুরুষেরা। ওয়ানগালা মূলত গারো সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। গারো বা মান্দি ভাষায় ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ নৈবেদ্য বা দেব-দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গ করা সামগ্রী। আর ‘গালা’ শব্দের অর্থ কোনো কিছু উৎসর্গ করা। আরও সহজ করে বলা যায়, এটি গারোদের নবান্ন উৎসব।

এ উৎসবের আগে তাঁরা কেউই নতুন উৎপাদিত ফসল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন না। আগেকার ওয়ানগালার সঙ্গে এখনকার ওয়ানগালার মৌলিক পার্থক্যটি হচ্ছে—একসময় তাঁরা সূর্য দেবতা মিসি সালজং বা সালজং মিদ্দিকে উৎসর্গ করতেন। আর এখন কোথাও কোথাও তা উৎসর্গ করা হয় যিশুখ্রিষ্ট বা ঈশ্বরের উদ্দেশে। আগে গারোপল্লির পাড়া-প্রতিবেশীরা নিজস্ব উদ্যোগে ওয়ানগালার আয়োজন করতেন। এখন তা আয়োজিত হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, গির্জা ও বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে। গারোদের একজন পুরোহিত আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রপাঠ, শস্য উৎসর্গ এবং মোরগ জবাই করে পর্বটি শেষ করেন। এ সময় একাডেমি মাঠেই অনুষ্ঠিত হয় গারো তরুণ-তরুণীদের নৃত্যের সঙ্গে গান। তাঁদের নাচ-গানে মুগ্ধ হন দূরদূরান্ত থেকে আগত দর্শনার্থীরা।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির পরিচালক সুজন হাজং বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি হাজার বছরের প্রাচীন এবং বৈচিত্র্যময়। এই অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতির চর্চা, সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি নিরলসভাবে কাজ করে আসছে। গবেষণা কর্মকর্তা সৃজন সাংমা বলেন, ‘বহু ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে। বিলুপ্ত এসব ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখনো যেসব ভাষা বা সংস্কৃতি-ঐতিহ্য আছে, সেগুলোর সঠিক লালন, উন্নয়ন ও বিকাশে কাজ চলছে।’