সোনালি ব্যাগ এল না, বাজার সয়লাব পলিথিনে

পরিবেশের কথা ভেবে ২০০২ সালে নিষিদ্ধ করা হয় পলিথিন। মাঝে মাঝে বাজারে অভিযান হয়। তবে পলিথিনের উৎপাদন থামছে না।

উদ্ভাবনের পর পাঁচ বছর পেরিয়েছে, কিন্তু এখনো বাণিজ্যিকভাবে সরাসরি বাজারে আসেনি পাটের তৈরি পচনশীল সোনালি ব্যাগ। পরিবেশবান্ধব এই ব্যাগের বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ব্যাগের সীমিত উৎপাদন সম্ভব হয়েছে কেবল। এই অবস্থায় প্রকল্পের সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে নির্ভরযোগ্য বিকল্পের অভাবে বাজার সয়লাব হয়ে আছে নিষিদ্ধ পলিথিনে। মাঝে হাতে ঝুলিয়ে ব্যবহার উপযোগী পলিথিন ব্যাগ বন্ধ ছিল। এখন সেই ব্যাগও বাজারে ফেরত এসেছে। কাঁচাবাজার, মুদিদোকান, শপিং মল, চেইন শপ—সব জায়গায় পলিথিনের ব্যবহার বাড়ছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পণ্য নিয়ন্ত্রণে মাঝে মাঝে অভিযানও চালানো হয়, কিন্তু পলিথিনের ব্যবহার কমেনি।

বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ হয় ২০০২ সালে। পরিবেশবিদেরা বলছেন, আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণেই পলিথিন থেকে মুক্তি মিলছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, পলিথিন নিয়ে চিন্তিত সারা বিশ্ব। প্রতিদিন লাখ লাখ টন পলিব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে, বর্জ্য হিসেবে তা পরিবেশ দূষণ করছে।

এ পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের জন্যই ক্ষতিকর পলিথিনের নির্ভরযোগ্য বিকল্প ভাবা হয়েছিল পাটের তৈরি পচনশীল সোনালি ব্যাগকে। এটি উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মোবারক আহমেদ খান, ২০১৬ সালে। বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসার আগেই সোনালি ব্যাগ দেশে-বিদেশে সাড়া ফেলেছিল। ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে সেই ব্যাগ পাঁচ বছরেও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনা যায়নি।

ঢাকার ডেমরার শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে সরকারি পাটকল লতিফ বাওয়ানী জুট মিল। সেখানেই সোনালি ব্যাগ তৈরির কারখানা। ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় এই ব্যাগ উৎপাদনের জন্য। ওই টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য কেনা হয়েছে। বর্তমানে হাজারখানেক সোনালি ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে প্রতিদিন। প্রতিটি ব্যাগ ১০ টাকা দামে শুধু মতিঝিলে অবস্থিত বিজেএমসির কার্যালয় থেকে কেনা যায়।

তিন বছর আগে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ খান জানিয়েছিলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি খুব দ্রুতই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারবেন। উদ্ভাবক বলছেন, সোনালি ব্যাগ বাজারজাত করতে আরও ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। তিনি এখন বড় আকারের সরকারি বরাদ্দ চাচ্ছেন, পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাও খুঁজছেন তিনি।

বিজেএমসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাণিজ্যিকভাবে সোনালি ব্যাগ বাজারে আনার ক্ষেত্রে মূল জটিলতা এখন একটি স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটেড) ব্যাগ সিলিং মেশিন কেনা; আর দরকার বড় আকারের অর্থায়ন।

মোবারক আহমেদ খান বলেন, পাইলট প্রকল্পে টার্গেট ছিল এক লাখ ব্যাগ উৎপাদন করা। তা সম্ভব হয়নি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ব্যাগ সিলিং মেশিনের অভাবে। এখন ২৪ ঘণ্টা যন্ত্র চালিয়ে ৯০ হাজার ব্যাগ উৎপাদন করা যায়। তিনি বলেন, স্থানীয় উদ্যোক্তারা যদি বিনিয়োগ করেন, তাহলে এটা আরও দ্রুত বাণিজ্যিক আকারে করা সম্ভব হবে। এই ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনার জন্য যা যা করা লাগে, সরকারি অর্থায়ন থেকে শুরু করে বেসরকারি উদ্যোক্তা—কোনো কিছুতেই বাধা নেই। তিনি বলেন, দৈনিক ১০ টন উৎপাদন করতে হলে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ লাগবে।

সরকারের কাছে অর্থ চেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে এই বিজ্ঞানী বলেন, ‘আমি জানিয়েছি। সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। সরকারও বুঝেছে, বিদেশে সোনালি ব্যাগের চাহিদা অনেক।’

বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রউফ জানান, পাইলট প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে। বিজেএমসির মিলগুলো বন্ধ। তবে সোনালি ব্যাগের প্রকল্পে তা প্রভাব ফেলবে না। তবে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা কঠিন।

বাজার সয়লাব পলিথিনে
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট, শান্তিনগর বাজার, হাতিরপুল ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাটজাত মোড়কের বদলে প্লাস্টিক বা পলিথিনের বস্তায় আটা, ময়দা, চিনি, ডাল, আদা, রসুন বাজারজাত করা হচ্ছে। তবে কিছু চালের দোকানে পাটের বস্তা ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ ডিসেম্বরঅভিযান ২ হাজার ৮৭১টিমামলায় দণ্ড ১০৪ জনজরিমানা আদায় ২০ কোটি ৬০ লাখপলিথিন জব্দ ১,২৩৬ টন

ব্যবসায়ীরা বলছেন, পলিথিনের কারণে পরিবেশের ক্ষতি হোক, তাঁরা তা চান না। কিন্তু পলিথিনের মতো সহজলভ্য কোনো পণ্য বাজারে নেই। শান্তিনগর বাজারে কথা হয় চাকরিজীবী মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে। তাঁর হাতে হাতওয়ালা পলিব্যাগে কমলা। পলিথিনের দিকে ইঙ্গিত করতেই বললেন, ‘দোকানদার দিলে কী করব। চারদিকেই তো পলিথিন আর পলিথিন। বন্ধ করার ব্যবস্থা তো দেখি না।’

একই প্রশ্ন করায় প্রথমে রেগে যান খিলগাঁও রেলগেটের সবজি বিক্রেতা মো. সোলায়মান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি কেজি পলিথিন তিনি ১৬০ টাকা কেজি দরে কেনেন। এর চেয়ে কম দামের বিকল্প কিছু তিনি পান না।

দৈনিক পলিথিনের হিসাব
২০০২ সালে দেশে পলিথিন নিষিদ্ধের পর বিকল্প হিসেবে সে সময় কাগজের ঠোঙার ব্যবহার কিছুটা বেড়েছিল। কিন্তু পলিথিনের চাপে টিকতে পারেনি কাগজের ঠোঙাও। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও ২০ বছর ধরে পলিথিন দূষণ নিয়ে চিন্তিত। ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে পলিথিনকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এসব নিয়ে কেবল আলোচনাই সার।

বাংলাদেশে প্রতিদিন কী পরিমাণে পলিথিন উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হয় এবং শেষে বর্জ্য হিসেবে নালা–নর্দমা, খালবিলে কী পরিমাণ জমা হয়—এ নিয়ে সরকারি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বা হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের প্ল্যাটফর্ম আর্থ ডে নেটওয়ার্কের ২০১৮ সালে করা ওই তালিকায় পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। প্রথমে আছে চীন, ভারত ১২তম অবস্থানে, পাকিস্তান ১৫তম ও মিয়ানমার ১৭তম অবস্থানে আছে। ‘প্লাস্টিক পলিউশন প্রিমিয়ার অ্যান্ড অ্যাকশন টুলকিট’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৭ লাখ ৯০ হাজার টন পলিথিন বর্জ্য জমা হয়। বাংলাদেশে একজন মানুষ দৈনিক ৪৩০ গ্রাম বর্জ্য তৈরি করে থাকে। এর মধ্যে ৮ শতাংশ তথা প্রায় ৩৫ গ্রাম প্লাস্টিক বর্জ্য। অর্থাৎ বছরে একজন মানুষ প্রায় ১৩ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে।

# দেশে বছরে একজন মানুষ ১৩ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে।# প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম।# বিশ্বে বছরে ৫ লাখ কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। এর ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়। ১০ শতাংশ চলে যায় সাগরে।

ডেনমার্কের কোপেনহেগেনভিত্তিক সংস্থা ‘দ্য ওয়ার্ল্ড কাউন্টস’ বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর পাঁচ লাখ কোটি পিস পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। এর মাত্র ১ শতাংশ পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়; আর সমুদ্রে ফেলা হয় ১০ শতাংশ। এসব পলিব্যাগ এক শ বছরেও পচে না, মাটির সঙ্গে মেশে না। ওই সংস্থার গতকাল সন্ধ্যার হিসাব বলছে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৭৬ হাজার ৪৭৩ কোটি পিস পলিব্যাগ উৎপাদিত হয়েছে।

উদ্যোগ, অগ্রগতি নেই
২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বাজারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে আবারও উদ্যোগ নেয়। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সে বছর ও ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ধান, চাল, ভুট্টা, সার, চিনিসহ ১৯টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তখন কিছু অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু জনবল ও তদারকির অভাবে অভিযানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। ফলে সরকারের সে উদ্যোগের সুফল আর মেলেনি।

জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবুল কালাম প্রথম আলোকে জানান, পলিথিন বন্ধ করা হলো, কিন্তু বিকল্প তো নেই। বিকল্প ব্যবস্থা করাও জরুরি। তিনি বলেন, পাট অধিদপ্তরের মাধ্যমে জেলা পর্যায়ে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়।

পলিথিন বন্ধে ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৮৭১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে। এসব অভিযানে মামলা করে ১০৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ২০ কোটি ৬০ লাখ ৯৩ হাজার ৬৮০ টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানগুলোতে ১ হাজার ২৩৬ টন পলিথিন ও প্লাস্টিকের দানা জব্দ করা হয়।

দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত
গত বছরের শুরুতে উচ্চ আদালত পলিথিন এবং একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা নিতে এক বছর সময় বেঁধে দেন। গত ৫ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। অধিদপ্তর আরও কিছুদিন সময় চেয়ে নেয় এবং ১০ ফেব্রুয়ারি তা আদালতে জমা দেয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)সহ ১১টি সংগঠনের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি আদালত ওই আদেশ দেন।

পলিথিন ঠেকাতে করণীয় জানতে চাইলে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, লোকদেখানো ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করলে লাভ হবে না। নিয়মিত বাজার তদারকি, পলিথিনের বিকল্প বাজারে আনা, আইনের নিয়মিত প্রয়োগ ও শাস্তি নিশ্চিত করা—এই চার পদক্ষেপ দ্বারাই পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব। পাশাপাশি মানুষকে বোঝাতে হবে, পলিথিনের ক্ষতি কতটা গভীর।

পলিথিন নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন। তিনি বলেন, সারা দেশেই পলিথিন তৈরির কারখানার সংখ্যা বেড়েছে। তাই এখন সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এটা বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।