সেরা পোলট্রি খামারি শাহিনুর

দোতলা বাড়ির নিচতলাজুড়ে বাচ্চা ফোটানোর ইনকিউবেটর। সেখানে ডিম থেকে মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। দোতলায় থাকেন মা-বাবা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। 

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বামনপাড়ায় গ্রামের তরুণ শাহিনুর রহমানের পুরো বাড়িটিই এখন খামারবাড়ি। নাম শাহিন পোলট্রি হ্যাচারি। সমন্বিত এ খামারে এখন সপ্তাহে ১০ হাজার মুরগির বাচ্চা উৎপাদিত হয়। ডিম, মুরগি, মুরগির বাচ্চা, দুধ বিক্রি করে মাসে সব খরচ বাদে মুনাফা হয় গড়ে এক লাখ টাকার বেশি।
সড়ক থেকে শাহিনুরের বাড়িতে যাওয়ার প্রায় আধা কিলোমিটার পথটা খুবই সরু। সেটা পায়ে হাঁটা। বর্ষাকালে পথে চলাই মুশকিল।
শাহিনুরের বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই শোনা গেল মুরগির ডাক। নিচতলায় একটি কক্ষে বসালেন। সেখানে দেয়ালে টাঙানো নানা পুরস্কারের ছবি। সবচেয়ে বড় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে নেওয়া জাতীয় কৃষি পদকের ছবিটি।
১৯৯১ সাল। বাবা মোহাম্মদ আলী অসুস্থতার কারণে ঢাকার পোশাক কারখানার চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান। সেখানে ৪০টি মুরগি দিয়ে খামার শুরু করেন। তখন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র শাহিনের প্রতিদিনের কাজ ছিল হাতে দুটি মুরগি নিয়ে রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে বিক্রি করা।
২০০২ সালে শাহিন ও তাঁর বাবা মুরগির খাবারের ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিযোগিতার বাজারে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেন। কিন্তু দমে যাননি। ২০০৬ সালে তাঁরা বামনপাড়ায় তিন কাঠা জমির ওপর হ্যাচারি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তখন তাঁদের ডিম ফোটানোর ইনকিউবেটর ছিল না। এ জন্য খামারের ডিম নিয়ে যশোর ও গোয়ালন্দ থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে আনতেন। কয়েক বছর পর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে একটি ইনকিউবেটর পান শাহিন। নিজেও পুরোনো একটি ইনকিউবেটর কিনে ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন শুরু করেন।
এখন নতুন নতুন বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন তিনি। খামারে নতুন যোগ হয়েছে ১৭টি গরু, ১০টি ছাগল, শতাধিক কবুতর ও টার্কি। টার্কির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বিক্রি শুরু করেছেন।

খামারে মুরগির পরিচর্যা করছেন শাহিনুর। সম্প্রতি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়। প্রথম আলো

এ আয় থেকে তিন কাঠা জমি থেকে খামারে সাত বিঘা জমি যোগ করেছেন। দুই ইউনিটের দোতলা পাকা ভবন, কোটি টাকার বিনিয়োগ। পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে খামারে প্রতিদিন সাত-আটজন শ্রমিক কাজ করেন। কৃষিতে অবদানের জন্য গত বছর শাহিনুর পেয়েছেন জাতীয় কৃষি পদক।
বাড়ির তিন দিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। পুরো এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে মোড়ানো। তার মধ্যেই ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির তিনটি বড় বড় খামার। সেখানে পাঁচ হাজারের বেশি মুরগি রয়েছে। পাশেই গোয়ালে গাভিসহ ১৭টি গরু। তার পাশে কবুতরের আবাসস্থল। নিজেই গম-ভুট্টা দিয়ে মুরগির মানসম্মত খাবার তৈরি করেন।
খামারের ইনকিউবেটরগুলো নিজেই চালান। মুরগির রোগ সম্পর্কেও ভালো ধারণা হয়েছে তাঁর। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ফলে একাধারে তিনি খামারের শ্রমিক, কারিগরি কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও বিপণনকর্মী।
খামারের পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে ২০১৫ সালে মাস্টার্স পাস করেছেন তিনি।
শাহিনের কাজ দেখে একই এলাকার অনেকে খামার করেছেন। আশপাশের জেলার শতাধিক যুবক মুরগি পালন ও কর্মসংস্থানে শাহিনুরের সহযোগিতা নিয়েছেন।
শাহিনুরের বাড়িতে যাওয়ার সরু পথটা প্রশস্ত করা গেলে খামারটা আরও বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে। সম্প্রতি সেরা খামারি (পোলট্রি) ক্যাটাগরিতে তীর–প্রথম আলো কৃষি পুরস্কার পেয়েছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।