পদ্মা সেতু চালুর পর নদ-নদীবেষ্টিত দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ সহজ হয়েছে। সড়কপথে এখন কম সময়েই ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় যাতায়াত করতে পারবে এ অঞ্চলের মানুষ। এতে লঞ্চ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
এত দিন এ পথে লঞ্চই ছিল যাতায়াতের মূল ভরসা। লঞ্চমালিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, লঞ্চভাড়া কম, নিম্ন আয়ের মানুষের যাতায়াত, সড়কপথ পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়াসহ বেশ কিছু কারণে এখনই চিন্তার কিছু নেই। বরং যাত্রীসংকটের চেয়ে নদীর নাব্যতা নিয়েই তাদের বেশি চিন্তা।
নৌপরিবহন খাতে বিনিয়োগকারীরা আরও বলছেন, লঞ্চের যাত্রা যেমন আরামদায়ক, তেমনি নিরাপদ। আবার রাতের যাতায়াতে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় না। একটি লঞ্চে দেড়-দুই হাজার যাত্রী পরিবহন করা যায়। এত যাত্রী সড়কপথে পরিবহনে ৩৫ থেকে ৪০টি বাসের প্রয়োজন। কিন্তু এ অঞ্চলের সড়কগুলো এখনো তেমন প্রস্তুত নয়। তাই ভবিষ্যতেও নৌপথের জনপ্রিয়তা থাকবে। এ ছাড়া লঞ্চ খাতে পর্যটনকেন্দ্রিক বিনিয়োগেরও চিন্তাভাবনা আছে তাঁদের।
লঞ্চ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা থেকে বিভিন্ন রুটে লঞ্চ চলাচল করে। সবচেয়ে বড় লঞ্চগুলো চলে ঢাকা-বরিশাল রুটে। এ রুটে ভায়াপথ মিলিয়ে অন্তত ২৫টি লঞ্চ চলাচল করে থাকে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল যাত্রী পরিবহন সংস্থার (যাপ) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু এ অঞ্চলের মানুষের আশার প্রতীক। কিন্তু সেতু চালু হলেও লঞ্চে যাত্রী কমবে না। কারণ, বাসে ঢাকা থেকে বরিশালে যেতে মাথাপিছু কমবেশি ৬০০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়। বিপরীতে লঞ্চে ভাড়া মাত্র ২৫০ টাকা। এ ছাড়া লঞ্চযাত্রা সাশ্রয়ী, ক্লান্তিহীন ও আরামদায়ক।
লঞ্চে ঢাকা-বরিশাল নিয়মিত যাতায়াত করেন বরিশাল নগরীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক সাজ্জাদুল হক। তিনি বলেন, ‘পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করলেও প্রতিষ্ঠানের কাজে মাসে চার থেকে পাঁচবার বরিশালে যাতায়াত করি। জরুরি না হলে লঞ্চেই বেশি যাতায়াত করি। আমার মনে হয় না, পদ্মা সেতু চালুর পর লঞ্চে খুব একটা প্রভাব পড়বে।’
কারণ হিসেবে সাজ্জাদুল বলেন, লঞ্চে যাতায়াতে ঝুঁকি কম, সময় নষ্ট হয় না। ভ্রমণও খুব আরামদায়ক। এ ছাড়া এ অঞ্চলের মানুষ যুগ যুগ ধরে লঞ্চযাত্রায় অভ্যস্ত।
তবে সেতু চালু হওয়ায় ভ্রমণের সময় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। এতে স্বাভাবিকভাবে সড়কপথে যাতায়াত বাড়বে। নৌপথে আগের মতো আর যাত্রীর চাপ থাকবে না। এ ক্ষেত্রে লঞ্চে যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর পরামর্শ এসেছে।
লঞ্চযাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বরিশাল নৌযাত্রী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান আবদুর রশিদ বলেন, পদ্মা সেতু লঞ্চ ব্যবসার জন্য কিছুটা হলেও মন্দাবস্থা তৈরি করবে। তবে লঞ্চমালিকেরা আন্তরিক হলে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এ জন্য লঞ্চে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর ভাড়া হতে হবে সহনীয়। যাত্রীদের বিমার ব্যবস্থাও করা উচিত।
বরিশাল অঞ্চলের লঞ্চ খাতে বিনিয়োগকারী আরেক ব্যবসায়ী সুরভি নেভিগেশনের পরিচালক রেজিন-উল কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিয়মিত যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে পর্যটনে লঞ্চ অনেক বড় অবদান রাখবে। ভবিষ্যতে ঢাকা থেকে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, চর কুকরি, হরিণঘাটা, চেংরাগিরিসহ অন্যান্য এলাকায় পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য অনেক ব্যবসায়ী লঞ্চে বিনিয়োগের চিন্তাভাবনা করছেন।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক ও বন্দর কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর আপাতত লঞ্চ ব্যবসার ঝুঁকি আছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে না। কারণ, এসব লঞ্চের আয়ের বড় উৎস হচ্ছে নিম্ন আয়ের যাত্রী, যাঁরা ডেকে কম খরচে আরামে যাতায়াত করেন। তাঁরা দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়া দিয়ে বাসে যাতায়াত করবেন না। তবে কেবিনে হয়তো যাত্রী কমবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘লঞ্চ ব্যবসায়ীরা পর্যটন খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে এখনো আমাদের কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো আবেদন জমা হয়নি।’
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
পদ্মা সেতু চালুর ফলে যাত্রীসংকটের চেয়ে নদীর নাব্যতা নিয়ে বেশি চিন্তিত লঞ্চমালিকেরা। ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটে নাব্যতা রক্ষায় জোর দিয়ে তাঁরা বলেন, নদীতে পর্যাপ্ত গভীরতা না থাকলে বড় লঞ্চ চলাচল সম্ভব নয়। এখন এটাই বড় চিন্তার কারণ। নদী নিয়মিত খনন করতে হবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বলছে, প্রতিবছরই দেশের গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে খননকাজ করা হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে বছর ঘুরতেই পলি জমে আবার নাব্যতা সংকট দেখা দেয়। ফলে আর্থিক ব্যয়ের পাশাপাশি ভোগান্তি লেগেই থাকে। এ জন্য নৌপথের টেকসই উন্নয়নের দিকে জোর দিচ্ছে সরকার।
২০২০ সালে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথ নিয়ে একটি বড় ধরনের সমীক্ষা চালানো হয়েছে। ‘বরিশাল বিভাগের নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা হ্রাস, জলাভূমি বাস্তু পুনরুদ্ধার, সেচ ও ল্যান্ডিং সুবিধাদি বৃদ্ধি করে নদী ব্যবস্থাপনার সম্ভাব্যতা যাচাই’ শীর্ষক সমীক্ষার প্রতিবেদন গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, বরিশাল বিভাগে ৩১টি নৌপথের মধ্যে মাত্র ৪টিতে নৌযান চলাচলের পর্যাপ্ত নাব্যতা আছে। বাকি ২৭টি নৌপথে শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা সংকট দেখা যায়।
প্রতিবেদনে নৌপথের টেকসই সুরক্ষার পাশাপাশি নদীর সীমানা পুনরুদ্ধার, জলাভূমির বাস্তু পুনরুদ্ধার করে সেচব্যবস্থার উন্নয়নের কথা বলা হয়। এ ছাড়া জলাবদ্ধতার মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা প্রতিরোধ করে এতে সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত নদী ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীগুলো দ্রুত ও স্বল্প সময়ে খনন এবং সংরক্ষণে বরিশাল নগরের কীর্তনখোলার তীরে মেরিন ওয়ার্কশপ মাঠে ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেজার বেজ নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরগুনায় নৌপথ খনন ও তদারকি কাজ সহজ হবে।