বিপুল ব্যয় করে দেশের বড় নদীর ওপর যে সেতু নির্মাণ সম্ভব, সেই সামর্থ্য প্রকাশ পায় ১৯৯৮ সালে। ওই বছরই যমুনা নদীর ওপর ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হয়। তখনই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা নদীতেও একটি সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৯ সালের মে মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা (প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি) শুরু হয়। বলা যায়, এটাই দালিলিকভাবে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম সূত্রপাত। এ হিসেবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের যাত্রা প্রায় দুই যুগের। ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত সেতুটি ২৫ জুন উদ্বোধন করা হবে।
পদ্মা সেতুর প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই হয় দেশীয় অর্থায়নে। ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ২০০৩ সালের মে থেকে তৎকালীন সরকারের সময়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার কাজ শুরু হয়।
প্রাক্–সম্ভাব্যতা ও সম্ভাব্যতা যাচাই কেন করতে হয়, সেই কৌতূহল জাগতে পারে। বিষয়টি হলো, পদ্মা নদীতে সেতু কেন দরকার, নির্মাণে ব্যয় কত হতে পারে, কোন জায়গায় সেতু নির্মাণ করলে ব্যয় কম হবে, সেতু নির্মাণে বিনিয়োগ অর্থনৈতিকভাবে কতটা যৌক্তিক হবে—সমীক্ষায় এসব বিষয় পর্যালোচনা করা হয়। এরপর সেতু নির্মাণের বিষয়ে প্রস্তাব দেয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাক্–সম্ভাব্যতা ও সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুরুতে এমনও আলোচনা ছিল যে সেতু নির্মাণ না করে পদ্মা পারাপারে ফেরি বাড়ানো ও ঘাট উন্নয়ন করলে সমস্যার সমাধান হয় কি না? পরে পরামর্শকেরা দেখান যে পদ্মা নদীতে ভাঙন বেশি। ফলে বারবার ফেরিঘাট স্থানান্তর করতে হয়। তীব্র স্রোতে ফেরি বা অন্য নৌযানে নদী পার হওয়া কঠিন। নৌযানডুবিতে প্রাণহানিও ঘটে। নৌযাত্রা সময়সাপেক্ষও। বিপরীতে সেতু নির্মিত হলে বাধাহীনভাবে দ্রুত নদী পাড়ি দেওয়া সম্ভব। অধিক সংখ্যায় মানুষ, যানবাহন ও মালামাল পরিবহন করা যাবে সেতু দিয়ে।
এরপরই সিদ্ধান্ত হয় পদ্মায় সেতুই হবে। এবার প্রশ্ন আসে, কোন পথে সেতুটি নির্মাণ করা হবে। প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় দুটি এবং সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় চারটি বিকল্প পথের সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণ করেন বিশেষজ্ঞরা। শেষ পর্যন্ত মাওয়া-জাজিরাতেই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আরপিটি-নেডকো-বিসিএল নামের যৌথ উদ্যোগের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা ১৯৯৯ সালের মে থেকে ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাজ করে প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিষ্ঠানটি পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া এবং মাওয়া ও জাজিরা—এই দুটি পথ দিয়ে সেতু নির্মাণের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে। তারা দেখায় যে পাটুরিয়ার তুলনায় মাওয়া দিয়ে সেতু নির্মাণ করা হলে যাতায়াত খরচ কমবে, পুনর্বাসনে ব্যয় কম হবে এবং নদীশাসন সহজ হবে।
সেতু নির্মাণ না করে নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ করা যায় কি না, সেটাও আলোচনায় আসে। কিন্তু টানেলের প্রযুক্তিগত জটিলতা এবং বেশি খরচের কারণে তা নির্মাণের সুপারিশ করেনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তারা চার লেনের সেতু এবং এর মধ্যে রেলসংযোগ রাখার পরামর্শ দেয়।
প্রাথমিকভাবে সড়ক ও রেলসংযোগ রেখে মাওয়ায় সেতু হলে ৯৩ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার (তখনকার মূল্যে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা) ব্যয়ের হিসাব দেখায় পরামর্শকেরা। আর পাটুরিয়া দিয়ে সেতু নির্মাণ করা হলে ব্যয় ১০০ কোটি ডলারের (প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা) বেশি দাঁড়াবে বলে জানায় তারা।
সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব পায় জাপানের নিপ্পন কোই লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা ২০০৪ সালের মধ্যেই সেতুর স্থান হিসেবে মাওয়া-জাজিরাকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে সরকারও একমত হয়।
শুরুতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেতু নির্মাণের জন্য চারটি সম্ভাব্য পথ নিয়ে পর্যালোচনা করে। এগুলো হলো পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ, দোহার-চরভদ্রাসন, মাওয়া-জাজিরা ও চাঁদপুর-ভেদরগঞ্জ। বিশ্লেষণের শুরুতেই দোহার-চরভদ্রাসন ও চাঁদপুর-ভেদরগঞ্জ বাদ পড়ে। কারণ, এই দুই পথে নদী এত চওড়া যে মূল সেতুর দৈর্ঘ্যই হতো ১০ কিলোমিটারের মতো। ফলে মূল প্রতিযোগিতা হয় মাওয়া-জাজিরা ও পাটুরিয়া-গোয়ালন্দের মধ্যে।
দেখা যায়, মাওয়া ও জাজিরা এবং পাটুরিয়া ও গোয়ালন্দ—দুই পথেই মূল সেতুর দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৬ কিলোমিটারের কিছু বেশি। তবে মাওয়া প্রান্তে নদীর তীর স্থিতিশীল। ফলে নদীশাসনে ব্যয় কম পড়বে। প্রক্ষেপণ অনুসারে, মাওয়া-জাজিরা দিয়ে সেতু নির্মিত হলে যানবাহন বেশি চলবে। রেলসংযোগ ছাড়া মাওয়ায় সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় দেখানো হয় ১১৫ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, তখন ১ ডলারের মূল্যমান ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৮ টাকা ২৫ পয়সা। পাটুরিয়া দিয়ে সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ব্যয় দাঁড়াবে ১৪৫ কোটি ডলার।
সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় বলা হয়, মাওয়া দিয়ে ফেরিতে ওঠার পর নদী পারাপারে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। পাটুরিয়ায় লাগে ৩৫ মিনিট। এর বাইরে পণ্যবাহী যানকে আড়াই ঘণ্টা এবং বাসকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত ফেরিঘাটে অপেক্ষা করতে হয়।
পদ্মা সেতু চালু হলে মানুষের যাতায়াত সহজ করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ।
দক্ষিণে এখন সুদিনের অপেক্ষা।