ব্রিটেনে চা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠলে দেশটির বেশ কিছু পরিবার চা ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়। তার মধ্যে স্যার থমাস লিপটন চায়ের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মুদি দোকানি, যিনি শুধু সিলন (বর্তমানে শ্রীলঙ্কা) থেকে চা আমদানি করে নিজের নামকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। আর্থার ব্রুক নামে আরেকজন ১৮৬৯ সালে ম্যানচেষ্টারে একটা চায়ের দোকান খোলেন। খদ্দেরদের ভালো চা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা বা বন্ড থেকে চায়ের নাম দেন তিনি ‘ব্রুক বণ্ড’। ১৯০০ সাল থেকে ভারতে ব্রুক বন্ড চা বিক্রি আরম্ভ হয়। একসময় বন্ড কোম্পানি লিপটনের ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ১৯২০-এর দশকে ব্রুক বন্ড বাজারে আসে টিনের কৌটা নিয়ে। তারা প্রচার চালায় যে তাদের এ টিনের কৌটাই চা সংরক্ষণের শ্রেষ্ঠ উপায়।
লিপটনের ব্যবসায় ব্রুক বন্ড যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করতে সমর্থ হয়। একপর্যায়ে ব্রুক বন্ডকে মোকাবিলা করতে লিপটন বিজ্ঞাপন দিতে বাধ্য হয় এই বলে যে, ‘আমরা চায়ের বিজ্ঞাপন দিই, টিনের পাত্রের নয়।’ বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি এবং দুই কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চা সারা ভারতে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রতিযোগিতায় টিকতে গিয়ে লিপটন কোম্পানি বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনও ব্যবহার করেছে—
চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতক দল চল চল চল হে
টগবগ-উচ্ছল কাতলিতল-জল কলকলহে
অনুমান করা যায়, রবীন্দ্রনাথের অনুমতি নিয়েই লিপটন কোম্পানি এটা করেছিল। ১৯৬৮ সালে ব্রুক বন্ড কোম্পানি লাইবিগ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্রুকবন্ড-লাইবিগ নাম ধারণ করে। ১৯৮৪ সালে ইউনিলিভার এটি কিনে নেয়। ইতোমধ্যে ‘লিপটন’-ও কিনে নিয়েছে ইউনিভার।
১৯৪০ সালে পূর্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ থেকে প্রকাশিত বাংলায় ভ্রমণ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে ভারতে ব্রিটিশ পুঁজি বিনিয়োগের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল চা–বাগান। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকজন ব্রিটিশ পুঁজিপতি ‘আসাম কোম্পানি’ নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আসাম বেঙ্গল রেলপথের প্রতিষ্ঠা ও চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন হলে ভারতে চা–শিল্পের অভাবনীয় প্রসার ঘটে এবং প্রচুর পরিমাণ ব্রিটিশ মূলধন এই শিল্পে লগ্নি করা হয়। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে যেই ইউরোপীয় পরিচালক পরিচালিত কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৫৮। ১০ বছর পরে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৪ তে।
করপোরেটের ভাষায় চা–বাগানের প্রতিনিধিদের ‘টি প্ল্যান্টার’ নামে সম্বোধন করা হয়। ‘বাগান ব্যবস্থাপক’ নামেও তাঁরা পরিচিত। সমাজ ও সাহিত্যে অবশ্য তাঁরা চা-কর নামেই খ্যাত হয়েছেন। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের লেখা ‘কোই হ্যায়? পূর্ববঙ্গে ইংরেজ সিভিলিয়ান’ শীর্ষক গ্রন্থে আইসিএস কর্মকর্তা আর্থার ড্যাসের ভাষ্যমতে, ‘চা-করদের মধ্যে নামকরা হলেন হিগিনস, যিনি ঈশ্বর ও মানুষ কাউকেই ভয় করেন না। পটিয়ায় তাঁর চা-বাগানের সামনে দিয়ে কোনো ভারতীয় ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে পারে না। ওই চা-বাগানের চারপাশে সরকারি বন। ওই বাগানে কেউ কাঠ কাটতে গেলে আট আনা দিতে হয়। সেখান থেকে কাঠ কেটে কেউ যদি চা-বাগানের মধ্য দিয়ে পেরোয় তা হলে তাকে আরও চার আনা লেভি দিতে হয় হিগিনসকে। সরকারি কর্তারা ব্যাপারটি জানেন। কিন্তু দেখেও না দেখার ভান করেন। হিগিনসের দুই জামাই। একজন পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার স্লেড হ্যাচিনসন, অন্যজন প্রিন্সিপাল টার্নার। চাঁদপুরেও চা–বাগান আছে।’ আর্থার ড্যাশের স্মৃতিকথার এই অংশ থেকে তখনকার দিনে ব্যবসাবান্ধব ব্রিটিশরাজের কাছে চা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর গুরুত্ব কী রকম ছিল, তা কিছুটা হলেও অনুধাবন করা যায়।
তবে সমকালীন সমাজে চা-করদের অবিশ্বাস্য দাপট থাকলেও তৎকালীন রেলওয়ের কর্মকর্তাদের আধিপত্যের দ্বন্দ্বে বিপাকে ছিলেন চা–কোম্পানির কর্মকর্তারা। রেলওয়ের এই আধিপত্য নিয়ে জেমস ফিনলে অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে ছিল তাঁদের স্থায়ী রেষারেষি। যেই চট্টগ্রাম শহর আবাদ করে তাঁরা প্রথম চা-বাগান প্রস্তুত করেছেন, প্রায় ৫০ বছর ধরে যাঁরা বন্দরকে তৈরি করেছেন, ‘দ্য ক্ল্যান লাইন’ নামে যাঁদের শিপিং লাইন রয়েছে, যাঁদের কোম্পানির আমদানি-রপ্তানি সুবিধার জন্যই তৈরি হয়েছে রেলপথ, তাঁরাই ছিলেন তখন রেলওয়ের কর্মকর্তাদের উন্নাসিকতার শিকার! এ বিষয়ে উল্লেখ করতে গিয়ে আর্থার ড্যাশ বলেন, চাটগাঁর প্রায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে। যেমন চিটাগাং ক্লাব, পোর্ট কমিশনার, চাটগাঁয় মাল ও যাত্রী পরিবহন, চাটগাঁর বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ, চাটগাঁর জমিজমা ও পাহাড়ি নিবাস।
চা-করদের অবসর বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল বরাহ তথা শূকর শিকার। পর্যাপ্ত পরিমাণে শিকারের সন্ধান মিললে অনুষ্ঠান আয়োজনের রেওয়াজ ছিল। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সম্মানিত ব্যক্তিদের সেখানে নিমন্ত্রণ জানানো হতো। চা-করদের অবসর কাটানোর আরেকটি মাধ্যম ছিল ক্রিকেট খেলা। বিশেষত শীতকালে ক্রিকেট, টেনিস, পোলো, রাগবি ও ফুটবল খেলার আয়োজন করা হতো। শারীরিকভাবে কর্মঠ ও সুস্থ থাকার জন্য চা-কররা নিয়মিত খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়াটা প্রয়োজনীয় মনে করতেন। নেটিভ সহকারী ও কর্মচারীদেরও তাঁরা ক্রিকেট খেলায় নিতেন। কারণ, তা না হলে দুটি দল গঠন করা অসম্ভব ছিল।
সেকালে বাঙালির দ্বারা পরিচালিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইংরেজি নাম রাখার একটা বাতিক ছিল। ধারণা করা যায়, ব্রিটিশ ভেবে পণ্যের কাটতি বেশি হবে এমন বিশ্বাস থেকেই এই নাম রাখার ঝোঁক। যে কারণে দ্বারকানাথ নিজের কোম্পানির নাম দ্বারকানাথ অ্যান্ড সন না রেখে ডোয়ার্কিন অ্যান্ড সন রেখেছিলেন। সেই একই কারণে আশুতোষ ঘোষ নিজের চায়ের ব্যবসার নাম রেখেছিলেন এ. টশ অ্যান্ড সন্স। টশের চা খেয়ে লোকে হয়তো ভাববে বিলিতি কোনো চা খাচ্ছে! বিষয়টা উল্টোভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। ব্রিটিশরা হয়তো সূক্ষ্ম কৌশলে বাঙালির বিষয়গুলোকে ইংরেজায়ন করে ফেলতে চাইত। তাই তো বিখ্যাত দার্জিলিং চা তাদের কাছে ছিল ‘ডারলিঙটন টি’ আর আসামের কাছাড় টি হয়ে গিয়েছিল ‘ক্যাচার টি’। সিলেটে প্রথম যে বাঙালি চা–বাগান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি হলেন সারদাচরণ শ্যাম। ১৮৯৬ সালে প্রায় চার হাজার ৫০০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ইন্দেশ্বর টি অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি।
চা–বাগানের ব্যবস্থাপক ও তাঁদের সহকারীদের মাঝে ‘কুলি বাত বা কুলি টক’ নামে একটা বিষয় বেশ প্রাধান্য পেত। যোগাযোগের প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য তাঁরা কুলিদের সচরাচর ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ নোটবুকে লিখে রেখে সেগুলো শেখার প্রয়াস পেতেন। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য এটা ছিল অপরিহার্য। ভাষা বোঝার ব্যাপারে যাঁর যত দক্ষতা, তিনি তত বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রমিক ব্যবস্থাপনায় সফল হতেন।
দেশীয় তত্ত্বাবধায়কদের মধ্যে মুহুরি ছিলেন প্রধান। তিনি সরাসরি ব্যবস্থাপকের নিকট থেকে পরামর্শ নিতেন এবং তাঁর কাজের জন্য জবাবদিহি করতেন। চা বাছাই, প্যাকেটজাতকরণ, ওজন পরিমাপ জাতীয় কাজ তদারকির পাশাপাশি সরদাররা মুহুরিকে শ্রমিকদের কাজের পরিমাণ ও মজুরির হিসাব সংরক্ষণে সহযোগিতা করতেন। ব্যবস্থাপকের অবর্তমানে সারা দিনে শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ, কাজের ক্ষেত্রে গাফিলতিসহ বিবিধ বিষয়ে নজরদারি ও খবরদারির দায়িত্ব পালন করতেন সরদার।
কালের পরিক্রমায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত প্রায়। একসময় যেখানে ব্রিটিশ ছাড়া বাঙালিদের কোনো মালিকানা ছিল না বাগানের, এখন সেখানে ঠিক তার উল্টো চিত্র। অধিকাংশ বাগানের মালিকানা এখন বাঙালির হাতে। দেশভাগের সময় অনেক বাগান বিক্রি করে ব্রিটিশরা চলে যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বাগানমালিকেরা ফিরে না আসায় তাঁদের মালিকানাধীন বাগানগুলো এখন পরিচালনা করছে সরকার।
আরও পড়ুন
* প্রথম পর্ব : ভারতবর্ষে চায়ের আবির্ভাব এবং পানীয়রূপে প্রতিষ্ঠা
* দ্বিতীয় পর্ব : চায়ের নানামুখী বিজ্ঞাপন এবং শিল্প-সাহিত্যে চা
* তৃতীয় পর্ব : বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণ ও চায়ের প্রসার
পঞ্চম পর্ব: চা–শ্রমিকদের ইতিবৃত্ত। পড়ুন ২১ নভেম্বর নাগরিক সংবাদে
* হোসাইন মোহাম্মদ জাকি: গবেষক