১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। ৪২ বছর এর রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবন (বাড়ি ১০, সড়ক ৩২ [পুরোনো], ১১ [নতুন]) এখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। ১৯৯৩ সালে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট জাদুঘরটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
আগস্ট মাসজুড়ে বাংলাদেশে জাতীয় শোকের মাস পালিত হচ্ছে। ২০১৭ সালের ১২ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ভবন বা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে দাঁড়িয়ে অতীতের স্মৃতিতাড়িত হয়ে নীরব হয়ে গেলাম। ৪২ বছর আগের ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি সেদিনের মতোই আমার মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলল। কতবার গিয়েছি এই বাড়িতে! ষাটের দশকে গিয়েছি অনেকবার, ১৯৭২–এ গিয়েছিলাম নাচোলের ইলা মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে।
আর গিয়েছিলাম ১৯৮১ সালের ১৫ আগস্ট, সেদিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি দেশে ফেরেন।
আমি সে সময় নারী আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলাম। আমার পেশাগত কাজ ছিল সাংবাদিকতা। সচিত্র সন্ধানী পত্রিকার সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের ডাকে ছুটে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু ভবনে; ১৯৮১ সালের ১৫ আগস্টে।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে পরের দীর্ঘ ছয়টি বছর ধূলিধূসরিত জীর্ণশীর্ণ পোড়োবাড়ির মতো দাঁড়িয়েছিল ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটি। সে সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে বাড়িটি দেওয়া হয়। এরপর মিলাদ হয় প্রায় প্রতিদিন। কী ঘটেছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে? আমরা সেই সময়ের অনেক খবরেরই তথ্য যাচাই করার সুযোগ পাইনি। সবারই একান্ত আগ্রহ ছিল এ বাড়িতে সেদিনের সেই ভয়ংকর রাতে কী ঘটেছিল সেটা দেখতে। সাংবাদিকদের জন্য এদিন সকালে বাড়িটি খুলে দেওয়া হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন সাংবাদিকদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। উপস্থিত িছলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পর্যায়ের অনেকেই। জোহরা তাজউদ্দীন, সাজেদা চৌধুরী, আইভি রহমান প্রমুখ। আরও অনেকের সঙ্গে সবাই খুব উত্তেজনার সঙ্গে, শিহরিত অনুভূতি নিয়ে পেছনের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যাই।
জুতা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সবাই। বাড়িটিতে অনেক শহীদদের রক্ত জমাট হয়েছিল তখনো—মেঝেতে, দেয়ালে, সিঁড়িতে। বাড়িটি শহীদ মিনারের পবিত্রতা নিয়ে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়, জুতা পায়ে এখানে প্রবেশ চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এটি জাতীয় স্মৃতিসৌধাগারের মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে একাশির ১৫ আগস্ট; দীর্ঘ ছয়টি বছর ধরে এই বাড়ির সব কটি ঘর ছিল তালাবদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছোটবেলা থেকে যে ছেলেটি কাজ করছিল, তার নাম রমা। সেদিন সে একটি ছোট টিনের বাক্সে জং-ধরা নানা ধরনের চাবি নিয়ে ঘুরছিল, প্রয়োজনে দরজা খুলে দিচ্ছিল। এই রমাই সেই ভয়াল রাতের হত্যাকাণ্ডের একজন সাক্ষী। সে কোনো রকমে পালিয়ে বেঁচেছিল।
আমরা সবাই দেখতে চাচ্ছিলাম বঙ্গবন্ধু যেখানে নিহত হয়েছেন, সেই স্থানটি। যদি নিচ থেকে যাতায়াতের চলতি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা যেত, তবে প্রথমে চোখে পড়ত সিঁড়ির বাঁক ঘুরেই ওপরের সিঁড়ির প্রায় শেষ মাথায় দু-তিন ধাপ আগেই জাতীয় পতাকা বিছিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার জায়গাটি পবিত্রভাবে রক্ষিত আছে। কিন্তু তখন সে পথটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রমার বর্ণনা এখনো যেন ছবির মতো স্পষ্ট: গেট পেরিয়ে লনের পাশ দিয়ে গাড়িবারান্দা হয়ে বাঁ দিকে ছোট একটা অভ্যর্থনা কক্ষ। তাঁকে পাশ কাটিয়ে বাঁ দিকের কাঠের দরজা খুলে গ্যারেজে ঢুকতেই দেখি আলপনা আঁকা, সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর দুই ছেলের বিয়ের, যা মাত্র কিছুদিন আগেই হয়েছিল।
আলপনার চারপাশে অদ্ভুত গোলাপি রঙের পানি জমে ছিল। সিঁড়ি ধোয়া পানি গড়িয়ে সেখানে এসে মিশেছিল। তখনো বোঝা যাচ্ছিল না এ বাড়িতে কী ভয়ানক দৃশ্য অপেক্ষমাণ। সিঁড়ির বাঁকে চশমার লেন্স ভাঙা গুঁড়ো শেলের টুকরো পড়ে ছিল। ওপরের দিকে তাকিয়েই সবার রক্তে সেদিন শিহরণ জেগেছিল।
১৯৮১ সালের ১৫ আগস্ট, আমরা তখনো পেছন দরজায় দাঁড়িয়ে। বঙ্গবন্ধুকন্যা, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেই প্রথম দোতলায় এসেছেন। তাঁর মনেও অনেক স্মৃতি জাগছিল নিশ্চয়ই। বাইরের জানালায় দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ চোখে দেখছিলেন ভেতরের তাণ্ডবলীলার স্থবির দৃশ্য। দরজা খুলতেই একরাশ গরম হাওয়া মুখে ঝাপটা মারল। একটা ছোট শোকেসে ভাঙাচোরা নানা জিনিসপত্র। বাঁ দিকে রঙিন মাছের অ্যাকুরিয়ামে মরে যাওয়া মাছ, মেঝেতে ধূলির আস্তরণ, সমস্ত দেয়ালে ধ্বংসের চিহ্ন—এসব দেখতে দেখতে মনে হয় যেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নিশুতি রাত এখনো থমকে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে রমার বিবরণ সেই ভয়াল রাতটাকে মূর্ত করে তোলে আমাদের সামনে:
‘সেদিন ঘাতকের দল নিচে শেখ কামালকে মেরে সিঁড়ি বেয়ে উঠেছিল। গোলমাল শুনে, গোলাগুলির আওয়াজে বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। স্বভাবসুলভ কণ্ঠে আঙুল উঁচিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘তোমরা কী চাও?’’ বুলেটের গুলিতে তারা সেই কথার উত্তর দিয়ে চলে যায় ভেতরের দিকে। পড়ে রইলেন বঙ্গবন্ধু, সেখানেই।
‘সিঁড়ির ওপরে উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর ঘরের দরজা। সেখানে উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন বেগম মুজিব। তাঁর পড়ে থাকার ধরন দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন দৌড়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, পথে কেউ হাতুড়ি দিয়ে তাঁর পা ভেঙে দিয়েছে—এমনই মচকে পা ভাঙা অবস্থায় পড়ে ছিলেন। হয়তো প্রথমেই তাঁর পায়ে গুলি লেগেছিল।
‘সিঁড়ির সঙ্গেই ডান দিকে শেখ জামালের ঘর, ভেতরে চারকোনা প্যাসেজ, একদিকে শেখ রেহানার ঘর, একদিকে বঙ্গবন্ধু এবং পাশেই শেখ হাসিনার ঘর। তিনতলায় শেখ কামালের ঘর। দরজায় দাঁড়িয়েই চারপাশের তছনছ অবস্থা, তাণ্ডবলীলার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। সেই রাতে গুলিগোলার আওয়াজে ভীতসন্ত্রস্ত সবাই ঘর থেকে দৌড়ে বঙ্গবন্ধুর ঘরে একত্র হয়েছিলেন। সেখানেই নিহত হয়েছিলেন সবাই।’
রমার বিবরণ শুনে আমরা স্তম্ভিত। এভাবে এ বাড়ির সব মানুষকে হত্যা করেও ঘাতকের দল শান্তি পায়নি! চোখের সামনে আমরা দেখছি, সব কটি ঘরে কীভাবে দস্যুরা হামলা চালিয়েছিল। প্রতিটি ঘরের বিছানা, বালিশ, তোশক, আলমারির কাপড়, স্যুটকেসের কাপড় তছনছ করা হয়েছিল। ঘরময় তুলো উড়ছিল তখনো। দেয়ালে দেয়ালে উইয়ের বাসা নিশ্চিন্তভাবে বেড়ে চলেছিল।
বঙ্গবন্ধুর বড় খাটের পাশে টেলিফোন তিনটির তার ছিল ছিন্নবিচ্ছিন্ন। ওপাশের দেয়ালে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে ছিল। আলনায় জায়নামাজটিও নীরব সাক্ষী হয়ে এই হত্যালীলা দেখছিল যেন।
আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, এ ঘরটি আমার ছিল। আক্রোশে ওরা ঘরের সবকিছু ওলট-পালট করেছে। পাশেই এ ঘরটি বাবার। এই ঘরেই মা, ভাই-ভাবিরা একত্রে নিহত হন। বাথরুমে ওরা চাচা শেখ নাসেরকে মেরে ফেলে।
৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে কী ঘটেছিল সেদিন রাতে, সে কথা ধীরে ধীরে বহুদিন পর্যন্ত মানুষ আলোচনা করেছে। জানতে পারেনি সব কথা, সাধারণের জন্য এ বাড়িতে প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। মিরপুর রোডের মাথায় ৩২ নম্বর রোডে ঢোকার রাস্তায় যানবাহন চলাচলের অনুমতি ছিল না। পথচলতি মানুষ বাড়িটির কাছে এসে আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত পাহারাদার দেখে বাড়িটির দিকে তাকাতেও ভয় পেত। বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে ছিল বুলেটের চিহ্ন। ফুটো হয়ে ঢুকে গিয়েছিল বুলেট ইটের গাঁথুনিতে। গাছের পাতারা নীরবে ঝরে পড়ছিল, মাঠের ঘাস বড় হচ্ছিল নির্বিবাদে।
এমন নীরব-নির্জন কখনোই ছিল না এ বাড়িটি। ওপরের বারান্দায় বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে প্রায় সময়ই সহাস্য বদনে সাক্ষাৎপ্রার্থী জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিতেন। প্রতিদিন এখানে প্রচুর জনসমাগম হতো। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যারাত পর্যন্তও বহু ভিড় ছিল বাড়িতে। কথা ছিল ১৫ তারিখ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাবেন। তারই প্রস্তুতিকাজে এ বাড়িতে ছিল অনেক ভিড়। ১৪ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বোন (শেখ মণির মা) এ বাড়িতে ছিলেন, একসঙ্গে খেয়েছেন, নানা ধরনের গল্প করেছেন ভাই-ভাবির সঙ্গে। তিনি ভাবতেও পারেননি সেই ভাইটি আর নেই, নেই তাঁর ছেলেরা, তাঁদের বধূরা। সেই সঙ্গে তাঁর নিজের ছেলে-বউ, ভগ্নিপতি—এমনকি আত্মীয়েরাও নিহত হলেন। এমন দুঃস্বপ্ন কী করে বাস্তব হলো, ভাবলেই তাঁর চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠত।
ঘাতকের সরাসরি আক্রমণের কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ঘরের নিজস্ব লাল টেলিফোনে তিনি বিশ্বস্ত অনুগামীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছিলেন, ‘তোরা একটা কিছু কর।’ কিন্তু কিছুই করা হয়নি। দেশের রাষ্ট্রপতি, এ দেশের জনগণের প্রিয় বঙ্গবন্ধু সপরিবারে অসহায় অবস্থায় গুটিকয়েক চক্রান্তকারী ঘাতকের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন।
সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যা ঘটেছিল, ১৯৮১ সালে যা দেখেছিলাম ও জেনেছিলাম, তার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আজ ২০১৭ সালে ভাবছি, কী সেই আক্রোশ, যার জন্য একটা পরিবার শুধু নয়, সমগ্র জাতিকেই ধ্বংস করে দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো? বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করাই শুধু উদ্দেশ্য ছিল ঘাতকদের, নাকি রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও দেশের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত করা ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য? এভাবেই একটি পরিবার, একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারের নির্দেশক হয়ে ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটি নির্জন-নীরব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চিরদিন এমন অন্ধকার থাকতে পারে না, আলো তাই জ্বলছে সেখানে, আবারও শত শত কণ্ঠে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিত হচ্ছে ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে।
মালেকা বেগম: অধ্যাপক, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।