সেই অবৈধ ফ্ল্যাট দুটি ‘হাতছাড়া’

রেফায়েত উল্লাহ
রেফায়েত উল্লাহ

দৃশ্যমান কোনো আয় নেই। তবু তাঁরা চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত এলাকায় দুটি ফ্ল্যাটের মালিক। তাঁদের একজন এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ও আরেকজন তাঁর ভাই।

দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, নিজের ‘ঘুষ’ ও ‘দুর্নীতির’ মাধ্যমে অর্জিত অর্থ গোপন করতে স্ত্রী ও ভাইয়ের নামে ফ্ল্যাট কেনেন পটিয়া থানার সাবেক ওসি মো. রেফায়েত উল্লাহ চৌধুরী। পাশাপাশি দুই ভাইকে তিনি দেন প্রায় এক কোটি টাকা।

তবে সেই সম্পদ আর নিজের দখলে রাখতে পারলেন না এই পুলিশ কর্মকর্তা। স্ত্রী ও ভাইয়ের নামে কেনা দুই কোটি টাকার ফ্ল্যাট দুটি আদালতের নির্দেশে এখন রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে।

চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় ওসি হিসেবে আড়াই বছর আগে কর্মরত ছিলেন মো. রেফায়েত উল্লাহ চৌধুরী। ২০১৭ সালে স্ত্রীর করা নির্যাতনের মামলায় সাময়িক বরখাস্ত হয়ে বর্তমানে তিনি রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত আছেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে।

দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে সম্পত্তিগুলো দেখাশোনা করতে ‘রিসিভার’ নিয়োগের নির্দেশ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাবেক ওসি রেফায়েতের ফ্ল্যাট দুটি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে রাখার জন্য একজন সহকারী কমিশনারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’

দুদক চট্টগ্রামের কোর্ট পরিদর্শক এমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সম্পত্তিগুলো যাতে হস্তান্তর ও বিক্রি করা না যায়, সে জন্য এর আগে ক্রোক করেন আদালত। ক্রোক করা সম্পত্তিগুলো তত্ত্বাবধানের জন্য রিসিভার নিয়োগের আদেশ দেন আদালত।

তাঁর ভাইয়েরা পোলট্রি ব্যবসা করেন। ব্যবসার টাকায় এসব কিনেছেন। তাঁর অবৈধ কোনো উপার্জন নেই।
রেফায়েত উল্লাহ, পুলিশ কর্মকর্তা

তারপরও অভিযোগের বিষয়টি মানতে চাননি পুলিশ কর্মকর্তা রেফায়েত উল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইয়েরা পোলট্রি ব্যবসা করেন। ব্যবসার টাকায় এসব কিনেছেন। তাঁর অবৈধ কোনো উপার্জন নেই। দুদকের মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁর কাছে সব কাগজপত্র আছে। স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর মিলমিশ হয়ে গেছে বলে দাবি করেন তিনি।

ওসি রেফায়েতের স্ত্রী নাসরিন আক্তারের মালিকানাধীন ফ্ল্যাটটি পাঁচলাইশের নাসিরাবাদ এলাকায় জুমাইরা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নামের অ্যাপার্টমেন্টের পঞ্চম তলায়। দুদক সূত্র জানায়, ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ২ হাজার ১৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি কেনা হয় ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর। অথচ গৃহিণী নাসরিন আক্তারের দৃশ্যমান আয় নেই। বৃহস্পতিবার জুমাইরা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে গিয়ে ফ্ল্যাটটি বন্ধ দেখা যায়। আশপাশের বাসিন্দারা জানান, ওসি রেফায়েতউল্লাহ আগে এখানে আসতেন।

একই দিন নগরের চান্দগাঁও এলাকায় উদয়ন অ্যাপার্টমেন্টের পঞ্চম তলায় ১ হাজার ৪৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটিতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি এটি নিবন্ধন করা হয় ওসি রেফায়েতের বড় ভাই আফতাব উল্লাহ চৌধুরীর নামে। পরের বছরের ২২ জুলাই ফ্ল্যাটটি আফতাব তাঁদের আরেক ভাই হাফিজ উল্লাহ চৌধুরীর নামে হেবা দান করে দেন। দুদক সূত্র জানায়, রেফায়েত উল্লাহ ছয়টি চেকের মাধ্যমে এবি ব্যাংক চট্টগ্রামের সিডিএ অ্যাভিনিউ শাখার মাধ্যমে মো. ইলিয়াছ নামের এক ব্যক্তিকে ফ্ল্যাটটি কেনা বাবদ ৫৭ লাখ টাকা টাকা পরিশোধ করেন।

দুদক জানায়, গত বছরের ১৯ অক্টোবর দুদক কার্যালয়ে ওসি রেফায়েত, তার দুই ভাই আফতাব উল্লাহ চৌধুরী ও হাফিজ উল্লাহ চৌধুরীকে আসামি করে ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধভাবে আয় করা সম্পদ গোপন করার জন্যই মূলত স্ত্রী ও ভাইদের নামে কেনেন ওসি রেফায়েত। ফ্ল্যাট কেনার মতো আয় স্ত্রী ও ভাইদের নেই। রেফায়েতের নামে–বেনামে আরও সম্পদ আছে কি না, তদন্ত করা হচ্ছে।

অবৈধভাবে আয় করা সম্পদ গোপন করার জন্যই মূলত স্ত্রী ও ভাইদের নামে কেনেন ওসি রেফায়েত। ফ্ল্যাট কেনার মতো আয় স্ত্রী ও ভাইদের নেই। রেফায়েতের নামে–বেনামে আরও সম্পদ আছে কি না, তদন্ত করা হচ্ছে।
মো. হুমায়ুন কবীর, দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক

দুদক জানায়, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ভাই আফতাব উল্লাহর নামে দিয়ে দেন রেফায়েত উল্লাহ। একই সময়ে হাফিজ উল্লাহর নামে দেন ৩০ লাখ টাকা। রেফায়েতের নামে ১২টি এবং স্ত্রী নাসরিনের নামের ছয়টি হিসাব নম্বর রয়েছে। আদালতের নির্দেশে হিসাব নম্বরগুলো জব্দ রয়েছে।