সূর্যপুরীর বাড়ি ঠাকুরগাঁও

সূর্যপুরী আম সূর্যপুরী ছোট মাঝারি আকারের আম, দেখতে সরু। গড় ওজন ১৪০ থেকে ১৬০ গ্রাম। আমটি পোক্ত অবস্থায় হালকা সবুজ, পাকলে ত্বক হলুদ রঙ ধারণ করে। আঁটি ও খোসা পাতলা। সামান্য আঁশযুক্ত হলেও বেশ রসাল।
ছবি: মজিবর রহমান খান

গরমের মৌসুমে উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও আলোচনায় আসে আমের জন্য। আমের বিশেষ জাত সূর্যপুরীর বাড়ি এ জেলায়। মিষ্টতা, স্বাদ, গন্ধে অতুলনীয় সূর্যপুরী ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়। দেশের অন্য অঞ্চলে এই আম হয় না বললেই চলে। জনপ্রিয়তায় ভর করে এ এলাকায় সূর্যপুরী আমবাগানের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে। এ জেলার ব্র্যান্ডিংও করা হয়েছে সূর্যপুরী আম দিয়ে।

সূর্যপুরীর নামকরণ বা উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে একেবারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।জনশ্রুতি আছে, আনুমানিক তিন শ বছর আগে তৎকালীন ভারতবর্ষের উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরের সূর্যপুর এলাকায় এই আমের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। ধারণা করা হয়, ওখান থেকেই আমের জাতটি এখানে আসে।

ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সমিরউদ্দিন স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ বেলাল রব্বানী এ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছেন। তিনি জানালেন, সূর্যপুরীর নামকরণ বা উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে একেবারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।জনশ্রুতি আছে, আনুমানিক তিন শ বছর আগে তৎকালীন ভারতবর্ষের উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরের সূর্যপুর এলাকায় এই আমের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। ধারণা করা হয়, ওখান থেকেই আমের জাতটি এখানে আসে। যেহেতু এই আম অত্যন্ত সুস্বাদু, তাই নাম ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি। আশপাশের এলাকায় দ্রুত পরিচিতি পায় এ আম। ঠাকুরগাঁওয়ের গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সূর্যপুরী আমগাছ পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।

সূর্যপুরী ছোট মাঝারি আকারের আম, দেখতে সরু। গড় ওজন ১৪০ থেকে ১৬০ গ্রাম। আমটি পোক্ত অবস্থায় হালকা সবুজ, পাকলে ত্বক হলুদ রং ধারণ করে। আঁটি ও খোসা পাতলা। সামান্য আঁশযুক্ত হলেও আমটি বেশ রসাল। এই আমের খাদ্যাংশ ৫৬ শতাংশ, মিষ্টতা প্রায় ১৭ শতাংশ। সূর্যপুরী আমে ভিন্ন ধরনের সুগন্ধ আছে। জুন মাসের শেষে আমটি পোক্ত হয় আর পুরো জুলাই মাস বাজারে পাওয়া যায়।

সূর্যপুরী একটি জনপ্রিয় জাত। এই আমটি কেবল ঠাকুরগাঁওয়েই ভালো হয়। এ কারণে জেলার ব্র্যান্ডিংও করা হয়েছে সূর্যপুরীকে ঘিরে। ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসকের বাসভবনের নামকরণও করা হয়েছে সূর্যপুরী।
কে এম কামরুজ্জামান সেলিম, জেলা প্রশাসক, ঠাকুরগাঁও

ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্তঘেঁষা বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা সূর্যপুরী আমের জন্য বিখ্যাত। সূর্যপুরী আমবাগানের সিংহভাগই এ উপজেলায়। উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখন এই আমের রাজত্ব। বাগানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ৫ হাজার ৭৪৭ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। এর মধ্যে দুই হাজার হেক্টরই সূর্যপুরী আমবাগান। বাস্তবেও তাই।

এ উপজেলায় দুই বিঘার বেশি জায়গাজুড়ে শতবর্ষী একটি সূর্যপুরী জাতের লতানো আমগাছ আছে। গাছটির উচ্চতা আনুমানিক ৮০-৯০ ফুট। মূল গাছের ঘের ৩৫ ফুটের কম নয়। গাছের তিন দিক থেকে ১৯টি মোটা ডালপালা বেরিয়ে অক্টোপাসের মতো মাটি আঁকড়ে ধরেছে। দূর থেকে মনে হয়, অনেকগুলো আমগাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। মৌসুমের এ সময় আমের ভারে আরও নুয়ে থাকে গাছটি। পৈতৃক সূত্রে এ গাছের মালিক নূর ইসলাম ও সাইদুর ইসলাম নামের দুই ভাই।

ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্ত ঘেঁষা বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা সূর্যপুরী আমের জন্য বিখ্যাত। এই উপজেলায় দুই বিঘার বেশি জায়গাজুড়ে আছে শতবর্ষী এই সূর্যপুরী জাতের লতানো আম গাছ।

খ্যাতির কারণে এ গাছের আমের কদর একটু বেশি। ব্যতিক্রমী গাছের সুস্বাদু আম পেতে আগ্রহী অনেকেই। অন্যান্য গাছের আম যেখানে বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকায়, ওই গাছের আমের দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকা।

এই গাছটি থেকে প্রতিবছর ১২০ থেকে ১৫০ মণ আম পাওয়া যায়। এ বছর মুকুল আসার পরপরই সলেমান আলী নামের এক আম ব্যবসায়ীর কাছে দেড় লাখ টাকায় আগাম বিক্রি করেছেন গাছের মালিক।

কথা হলো সলেমান আলীর সঙ্গে। তিনি একটি প্রবচন মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমে ধান, তেঁতুলে বান।’ অর্থাৎ যে বছর ধান ভালো হয়, সে বছর আমের ফলনও ভালো হয়। এ বছর এ অঞ্চলে ধান ভালো হয়েছে। আমও ভালো হয়েছে। তিনি বলেন, এ এলাকার আমবাগানগুলো নিরাশ করে না। এক বছর ফলন কম হলে পরের বছর তা পুষিয়ে দেয়।

বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়পলাশবাড়ি এলাকা আমচাষি আবদুর রহিম সূর্যপুরী আমের বাগান করেছেন। তাঁর বাগানেও থোকায় থোকায় ঝুলছে আম। পাশের বাগানের মালিক হারুন আর রশিদ জানালেন, এলাকায় দিন দিন আমের বাগান বাড়ছে।

মৌসুমে আমরা নানা জাতের আম খাই। কিন্তু সূর্যপুরী আম মুখে না তুললে আম খাওয়া যেন অপূর্ণ থেকে যায়। তাই যেখানেই থাকি সূর্যপুরীর স্বাদ নিতে এ সময় এলাকায় চলে আসি।
আতিকুল ইসলাম, বেসরকারি সংস্থার কর্মী

আমচাষি মশিউর রহমান বলেন, এলাকায় দুইভাবে আমের বাগান পরিচালিত হয়। অনেক মালিক গাছে মুকুল আসার সময় মৌসুমি ফল ব্যবসায়ীর কাছে তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য বাগান বিক্রি করে দেন। আবার অনেকে নিজেই পরিচর্যার পর আম পরিপক্ব হলে দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীর কাছে তা বিক্রি করেন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যায় এই আম। গতবার প্রতি মণ আম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এবার দাম আরেকটু বাড়বে বলে আশা ব্যবসায়ীদের।

একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন আতিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৌসুমে আমরা নানা জাতের আম খাই। কিন্তু সূর্যপুরী আম মুখে না তুললে আম খাওয়া যেন অপূর্ণ থেকে যায়। তাই যেখানেই থাকি সূর্যপুরীর স্বাদ নিতে এ সময় এলাকায় চলে আসি।’

জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, সূর্যপুরী একটি জনপ্রিয় জাত। এই আমটি কেবল ঠাকুরগাঁওয়েই ভালো হয়। এ কারণে জেলার ব্র্যান্ডিংও করা হয়েছে সূর্যপুরীকে ঘিরে। ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসকের বাসভবনের নামকরণও করা হয়েছে সূর্যপুরী।