দলমত-নির্বিশেষে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে বললেন গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন।
আজ শুক্রবার সকালে রাজধানীর সুপ্রিম কোর্টের শামসুল হক চৌধুরী হলে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ‘আইনের শাসন ও গণতন্ত্র’ শীর্ষক মতবিনিময় সভাটির আয়োজন করে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘এই সংবিধান যেটাকে আমরা ধরে রেখেছি, তা বহু মূল্য দিয়ে পেয়েছি। এখানে আপস করার কোনো সুযোগ নেই।’। তিনি বলেন, ‘এ দেশে স্বৈরাচার কোনো দিন টিকে থাকতে পারবে না। গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরতন্ত্র কোনো দিন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। এটা আমার বিশ্বাস। এটা আমরা বহুবার প্রমাণ করেছি। কিন্তু দুঃখ লাগে ৪৬ বছর পরে আবার আমাদের দেশে আন্দোলনের কথা বলতে হচ্ছে। স্বৈরতন্ত্র এখানে চিরস্থায়ী থাকতে পারবে না, নির্বাচনকে সুষ্ঠু হতে হবে।’
ড. কামাল বলেন, ‘আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধানকে অপমান যারা করেছে, তাঁরা অসাংবিধানিক কাজ করেছে। আজ হোক, কাল হোক তাঁদের বিচার হতে হবে। আমরা বিচার করা ভুলে গেছি বলে অন্যায় বার-বার হচ্ছে। এই দেশকে বঞ্চিত করা হলো একজন নীতিমান, সৎ, সাহসী প্রধান বিচারপতি থেকে।’
সভায় সভাপতির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘দেশের প্রেক্ষাপট হচ্ছে বিচার বিভাগের নিম্ন আদালতগুলো সরকার ও প্রশাসনের কবজায়। সেগুলো ইচ্ছা মতো পরিচালিত হচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। সুপ্রিম কোর্টও তাঁদের কবজায় বলে মনে হচ্ছে। দেশের জনগণ সুপ্রিম কোর্টের ওপর আস্থা রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। এমনকি দেশের প্রধান বিচারপতিকে বের করে দেওয়ার পরে আইনজীবী সমাজ শঙ্কিত।’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘গণতন্ত্র ও আইনের শাসন একে অন্যের সম্পূরক। যেখানে গণতন্ত্র থাকে না, সেখানে আইনের শাসন থাকে না। দেশে তো গণতন্ত্র এখন নির্বাসিত। এর জন্য দায়ী আওয়ামী সরকার। এর থেকে উত্তরণের পথ একটাই গণতন্ত্র কায়েম করে ভোটাধিকার দিতে হবে। শুধু পেশাজীবীদের রাস্তায় নামলে চলবে না, সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বলেন, ‘আইনের শাসন ও গণতন্ত্র নিয়ে দেশে অনেক আলোচনা হয়েছে। দেশে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। আতঙ্কের কারণে মানুষ কথা বলতে পারছে না, মানুষ রাস্তায় নামছে না। কেমন যেন একটা ভীতির চাদর বিছানো চারপাশে। বর্তমানে যে সরকার আছে, তার কাছে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র আশা করা অলীক কল্পনা।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই। এমনকি তা প্রবিধান করার জন্য কোনো আইন নেই। তাই পেশাজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে। লড়াই করার মতো লোক লাগবে। একমাত্র গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ব্যবস্থাই এ সমস্যা থেকে উত্তরণ করবে দেশকে।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘দেশে যে গণতন্ত্র আছে, তা ভেজাল। যেখানে ভেজাল সেখানে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন? এই ভেজাল গণতন্ত্র থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার সম্মিলিত চেষ্টা।’
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘দেশের আইনের শাসন ও গণতন্ত্র না থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে পেশাদারি সংগঠনগুলোর লেজুড়বৃত্তি আচরণ। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে আজ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র বিভাজিত। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে পেশাদারি সংগঠনের লেজুড়বৃত্তি কমাতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘দেশ চলার কথা আইন অনুসারে এবং আইন প্রয়োগ হবে সমভাবে। আজকের বাংলাদেশে গুম, ক্রসফায়ার, ব্যাংক লুটের বিচার দেখি না। আবার যারা ভিন্ন মতের, সরকারের সমালোচনা করেন, তাঁদের বেলায় আইনের অপপ্রয়োগ হয় ঠিকই। তিনি আরও বলেন, ‘আজকে দুঃখ লাগে, এর চেয়ে কম দুঃশাসন, অরাজকতা যখন দেশে ছিল, তখন জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। অথচ আজকে এত অন্যায়, অনাচার হচ্ছে, আর কত সর্বনাশ দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করব। যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের সংবিধানও থাকে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও থাকে না।’
ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল মতিন বলেন, ‘গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত নির্বাচিত সরকার। এই সরকার জনগণের দ্বারা গঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার নয়।’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘আমি তো দেশে গণতন্ত্র দেখি না, দেখি একনায়কতন্ত্র। একজনের ইশারা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ছে না। গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই, আছে পুলিশের শাসন। ৫ জানুয়ারির মতো একটা নির্বাচন আমরা আর চাই না। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন স্বৈরতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরেছে। যে দেশে আইনের শাসন নাই, একটি দল জনসভা করতে পারে না, মতো প্রকাশ করতে পারে না। সে দেশে কোথায় গণতন্ত্র? উল্টো আইসিটি আইন হয়েছে, ডিজিটাল আইন করা হচ্ছে, মতো প্রকাশ রোধ করতে।’