বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও ব্যাংকটির বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না, এ প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আপনারা পদক্ষেপ না নিলে প্রয়োজনে আদেশ দেওয়া হবে। তাঁদের ব্যাপারে কিছু করা হচ্ছে না কেন? প্রাথমিক সত্যতা না পেলে ছেড়ে দেবেন, পেলে তাঁদের কারাগারে অবশ্যই পাঠাতে হবে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে মেহমানদারি করতে পারেন না।’
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার শুনানিতে এসব কথা বলেন। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচারের ঘটনায় অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের বিরুদ্ধে দুদকের কার্যক্রম নিয়ে এ শুনানি হয়।
উল্লেখ্য, বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন এস কে সুর চৌধুরী ও শাহ আলম। দুজনের বিরুদ্ধে পি কে হালদারের দখল করা বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অবৈধ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আর পি কে হালদার এখন পলাতক। তাঁর সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হক আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে প্রতি মাসে দেওয়া হতো ২ লাখ টাকা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।
শুনানিতে দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, জবানবন্দিতে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তখন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, জবানবন্দিতে যাঁদের নাম পাওয়া গেছে, তাঁদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকে কারাগারে আছেন, অনেকে পলাতক।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর ‘পি কে হালদারকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে দুদক’ শিরোনামে একটি দৈনিকে প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি বিবেচনায় নিয়ে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত রুল দেন এবং তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে নেওয়া পদক্ষেপ বিষয়ে লিখিতভাবে দুদক চেয়ারম্যানসহ বিবাদীদের জানাতে বলেন। এ ছাড়া পাসপোর্ট জব্দ থাকার পরও পি কে হালদার কীভাবে দেশত্যাগ করলেন, তখন ইমিগ্রেশন ও দুদকের কারা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের নাম ১৫ মার্চ দাখিল করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে অর্থ পাচার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তদারকি-নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট তিন বিভাগে গত এক যুগে (২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত) দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দাখিল করতে নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল শুনানি হয়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক ৫৯ জন ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্যের তালিকা দাখিল করেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ওই সময় দায়িত্ব পালন করা (তিনটি বিভাগে) ৩৫৪ জন কর্মকর্তার তালিকা দাখিল করা হয়।
শুনানিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পি কে হালদার ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর ৩টা ৩৮ মিনিটে বেনাপোলে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। ২২ অক্টোবর দুদক পি কে হালদারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার চিঠি ইমিগ্রেশন পুলিশ বরাবর চিঠি পাঠায়। এই চিঠি ২৩ অক্টোবর সাড়ে ৪টায় ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে পৌঁছায়। এর পরপরই ২৩ অক্টোবর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিটে সব বন্দরকে পি কে হালদারের বিষয়ে অবহিত করে। সেদিন ইমিগ্রেশন পুলিশের ৫৯ জন সদস্য বেনাপোল স্থলবন্দরে দায়িত্বে ছিলেন। পি কে হালদারের পালিয়ে যাওয়ার পরে দুদকের চিঠি তাঁরা পেয়েছেন।
আদালত বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দর কখন নিষেধাজ্ঞার আদেশ পেল? জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ৫টা ৪৭ মিনিটে। আদালত বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার আদেশ কবে দেওয়া হয়?’ তখন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর।’ তিনি বলেন, ‘পি কে হালদারকে দুদকই প্রথম চিহ্নিত করে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ৪৫ জনের নাম আসে, তখন তাঁর প্রসঙ্গ আসে।’
এই আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘২২ অক্টোবর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার চিঠি ইস্যু করেছেন। চিঠি ইস্যু করার আগে ইচ্ছে থাকলে তাঁকে ধরে ফেলতে পারতেন।’ খুরশীদ আলম খান বলেন, তখন পর্যন্ত পি কে হালদারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। দুদক নিজে সন্দেহভাজন হিসেবে তাঁর নাম দিয়েছে।
একপর্যায়ে আদালত বলেন, দুদকই হোক অথবা অন্য কেউ, কারও না কারও আন্তরিকতার অভাব অবশ্যই পরিলক্ষিত হয়। অবহেলা বা গাফিলতি কার তা চিহ্নিত করা হবে। হলফনামা আকারে এ–সংক্রান্ত তথ্য দুদককে দাখিল করতে বলে ৬ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির দিন রাখা হয়।
এরপর গত এক যুগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তিন বিভাগে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তার নাম–পদবিসহ তালিকা দাখিল করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী তানজিব উল আলম। তাঁর সঙ্গে শুনানিতে ছিলেন খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ।
শুনানিতে তানজিব উল আলম বলেন, পি কে হালদারদের চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। প্রতিটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যাঁরা যাঁরা (বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা) ইনভেস্টিগেশনে ছিল এবং তাঁদের প্রতিটি বছরের প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করতে হবে। এ জন্য ছয়-সাত সপ্তাহ সময়ের আরজি জানান তিনি। আদালত সাত সপ্তাহ সময় মঞ্জুর করেন।