সাফল্য

সুখের দিন এনে দেওয়া সুমাইয়া

অসহনীয় একটা সময় কাটানোর পর বাবা-মায়ের সঙ্গে আবার হাসিমুখে সুমাইয়া। ছবি: সাজিদ হোসেন
অসহনীয় একটা সময় কাটানোর পর বাবা-মায়ের সঙ্গে আবার হাসিমুখে সুমাইয়া। ছবি: সাজিদ হোসেন

সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি। অ্যাসাইনমেন্ট সেরে সবে ঢুকেছি নিউজ রুমে। ভীষণ তাড়ায় আমি। হঠাৎ প্রথম আলোর অভ্যর্থনাকর্মী সনি আপা ডেস্কের ওপর একটি ছবি রেখে বললেন, ‘আপা, দেখেন, কী সুন্দর বাচ্চা! ওকে পাওয়া যাচ্ছে না, অনেক দিন হলো। ওর বাবা-মা বসে আছে। কথা বলেন না একটু।’ ছবিটি দেখলাম। ঠিক আমার মেয়ে সোম নীলের বয়সী। ডোরাকাটা গেঞ্জি গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে হাসি। একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে ছুটলাম। শুনলাম, হারিয়ে যাওয়া শিশুটির নাম সুমাইয়া। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের বড়গ্রামে ওদের বাড়ি। বাবা জাকির হোসেন ও মা মুনিয়া বেগমের একমাত্র মেয়ে সে। পুলিশ, র‍্যাব—সব ঘুরে পত্রিকা অফিসে এসেছেন তাঁরা। দুই সপ্তাহ হতে চলল, মেয়ের কোনো খোঁজ নেই।

নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির বদলে আমি ছোট্ট করে একটি প্রতিবেদন লিখলাম। রাজধানী পাতায় ছাপা হলো সেটি। নাহ্‌, কোনো খোঁজ নেই। আমার খুব অস্থির লাগতে শুরু হলো। আচ্ছা, সুমাইয়ার ভাগ্যে ঠিক কী ঘটতে পারে? ওকে কি কেউ বিক্রি করে দেবে? পাচার হয়ে যাবে শিশুটি? ও কি কোনো দিন ওর বাবা-মায়ের কাছে ফিরতে পারবে না? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি কামরাঙ্গীরচরের বড়গ্রামে গেলাম। ফলোআপ করব। শিশুটিকে খুঁজে পেতেই হবে।

এলাকায় পৌঁছে দেখি জাকির ভাই দাঁড়ানো। সেদিনও পোস্টার সাঁটতে বেরিয়েছেন। উদ্‌ভ্রান্তের মতো দৌড়াচ্ছেন, ফাঁকে ফাঁকে সুমাইয়াকে নিয়ে এলাকার লোকজনের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। বুঝলাম, আমাদের সুমাইয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পরিচয়’ কবিতার খুব পরিচিত মেয়েটির মতো: ‘একটি মেয়ে আছে জানি,/ পল্লীটি তার দখলে,/ সবাই তারি পুজো জোগায়,/ লক্ষ্মী বলে সকলে।/ আমি কিন্তু বলি তোমায়,/ কথায় যদি মন দেহ—/ খুব যে উনি লক্ষ্মী মেয়ে/ আছে আমার সন্দেহ।’

আমি সুমাইয়াদের বাসায় গেলাম। এক কক্ষের বাসা। বাবা-মায়ের বালিশের পাশে সুমাইয়ার বালিশটা পড়ে আছে। আচ্ছা, বালিশটাও কি ওর জন্য অপেক্ষা করছে? ঘরজুড়েই তো দেখি শুধুই সুমাইয়া। ছোট্ট পানির মগ, ছোট্ট টুথব্রাশ, ছোট ছোট মাথার ক্লিপ, দু-একটা খেলনা; কত কথা যে মনে হতে লাগল! কথায় কথায় জানলাম, মেয়েটি হেঁটে চলে যাচ্ছে এমন একটি ফুটেজ আছে। অপহরণকারীর মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে এলাকার লোকজন এই অপহরণকারীকে চেনেন। একটা সময় জাকির-মুনিয়ারা যে ঘরে থাকতেন, সে ঘরেই ভাড়া থাকতেন। নাম অথৈ আক্তার বৃষ্টি। সুমাইয়া যেদিন হারিয়ে যায়, সেদিনও এই নারী এসেছিলেন সুমাইয়াদের বাসায়। তাঁর একটি মুঠোফোন নম্বরও আছে। এবার আমার চোখ সত্যি কপালে উঠল। এত এত সাক্ষ্যপ্রমাণ, তবু অপহরণকারীকে পাওয়া যাচ্ছে না? কী আশ্চর্য!

ফিরে এসে লিখলাম ‘সুমাইয়াকে কি আর পাওয়া যাবে না?’ খবরটি ছাপা হলো প্রথম পাতায়। এবার আমি পুলিশ সদর দপ্তরেও যোগাযোগ করতে লাগলাম। পুলিশ কর্মকর্তারা সাড়া দিলেন। তবু শঙ্কা যায় না। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন। ২৭ এপ্রিল ভোরে হঠাৎ ফোন। অপর প্রান্তে মুনিয়া বেগম, ‘আপা, সুমাইয়াকে পাওয়া গেছে! আমরা থানায়। এই যে কথা বলেন।’ আমি কি স্বপ্ন দেখছি? ফোনটা কি সত্যি বেজেছে? আমি উঠে বসলাম। ও মা, এ তো দেখি সত্যিই সুমাইয়া! কচি গলায় বলল, ‘স্লামালিকুম, আন্টি। ভালো আছো তুমি? আমি ভালো আছি।’
তারপরের গল্প তো সবারই জানা। আমার এক সাবেক সহকর্মী বললেন, ‘আপা, সুমাইয়াকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। আজ অফিসে ঢুকতেই একজন খবরটা দিল। জানেন, সুমাইয়াকে না পাওয়া গেছে!’ আমি বললাম, ‘আজকে মোদের বড়ই সুখের দিন।’