পরিবারের কল্যাণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি। কল সেন্টারটি কিশোর-কিশোরীদের বন্ধু।
রাজধানীর কাঁঠালবাগানের এক বাসিন্দা ২৮ মে বিকেলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কল সেন্টারে ফোন করেছিলেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কোন হাসপাতালে গেলে তাঁর আত্মীয়ের স্বাভাবিক প্রসব নিশ্চিত হবে, অস্ত্রোপচারের জন্য কেউ জোরাজুরি করবে না।
কল সেন্টার থেকে ওই ব্যক্তিকে প্রসব-পূর্ববর্তী কী কী সেবা নেওয়া প্রয়োজন, তা প্রথমে জানানো হয়। এরপর বলা হয়, স্বাভাবিক নাকি অস্ত্রোপচারে প্রসব হবে, তা সঠিক পরীক্ষার পর একজন চিকিৎসকই বলতে পারবেন। এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের রাজধানীর আজিমপুর ও মোহাম্মদপুরের দুটি মাতৃস্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রের চিকিৎসকেরা। এ-ও বলা হয়, ওই দুটি কেন্দ্রে নিয়মিত স্বাভাবিক প্রসব হয়।
কল সেন্টারের এজেন্টরা প্রশ্নের উত্তর দেন। কিছু ক্ষেত্রে কল ট্রান্সফার করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে। কেউ যদি শুধু নারী বা শুধু পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে চান, সেই বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগও আছে।
প্রতিদিন সারা দেশের বহু লোক এই কল সেন্টারে ফোন করে বিশেষায়িত পরামর্শসেবা পান। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এই কল সেন্টারের নাম ‘সুখি পরিবার ১৬৭৬৭’। ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা এই কল সেন্টার খোলা থাকে। দিনের যেকোনো সময় ফোন করে এই কেন্দ্র থেকে সেবা ও পরামর্শ পাওয়া যায়। অধিদপ্তরের তথ্য, শিক্ষা ও উদ্বুদ্ধকরণ (আইইএম) শাখার অধীনে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে কেন্দ্রটির যাত্রা শুরু। ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে কেন্দ্রটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিনেসিস আইটি। প্রশিক্ষণ পাওয়া ২০ জন কল সেন্টার এজেন্ট ও ৫ জন চিকিৎসক মানুষের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। চিকিৎসকেরা কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপত্রও দেন।
‘তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। এটি বিশেষভাবে কাজে লাগছে কিশোর-কিশোরীদের, যারা কিছু কথা গোপনে বলতে চায়। তবে কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা দরকার।মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই এই সেন্টার গড়ে তোলার উদ্দেশ্য। অধিদপ্তরের আইইএম শাখার পরিচালক আমির হোসেন বলেন, ‘প্রান্তিক লোকজন কল সেন্টারে ফোন করে প্রয়োজনীয় প্রসূতি, নবজাতক ও শিশুসেবা পান। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জরুরি সেবা কোথায় পাওয়া যাবে, সেই পরামর্শও আমরা দিই। কখন কোন সেবা নিতে হয়, তা অনেকে জানেন না, অনেকের মনে থাকে না। আমরা তা স্মরণ করিয়ে দিই।’
গত শনিবার কেন্দ্রের দুজন কল সেন্টার এজেন্ট প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে এখনো জানেন না কী কী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি দেশে আছে। কনডম ও খাওয়ার বড়ির কথাই বেশি জানেন লোকজন। কেউ যখন কল সেন্টারে ফোন করে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চান, তখন সব ধরনের পদ্ধতি, পদ্ধতির ব্যবহারের কৌশল, সুবিধা-অসুবিধা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়। তাঁদের বলে দেওয়া হয়, কোথায় বিনা মূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি পাওয়া যায়।
মাসিক বন্ধ থাকা, মাসিক নিয়মিতকরণ, গর্ভধারণে জটিলতা—এসব সমস্যা নিয়ে অনেকে পরিচিতজনের কাছে, এমনকি চিকিৎসকের কাছে লজ্জায় মুখ খুলতে চান না। লোক জানাজানির ভয়ে অনেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অথবা স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকের কাছে যান না। তাঁরা কল সেন্টারে ফোন করে স্বাচ্ছন্দ্যে সমস্যার কথা বলেন। কল সেন্টারের এজেন্টরা প্রশ্নের উত্তর দেন। কিছু ক্ষেত্রে কল ট্রান্সফার করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে। কেউ যদি শুধু নারী বা শুধু পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে চান, সেই বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগও আছে।
মানুষ শুধু কল সেন্টারে ফোন করে নিজের সমস্যার সমাধান জানতে চান, তা নয়। কল সেন্টার নিজ উদ্যোগেও মানুষের কাছে ফোন করে। তবে এই সেবা শুধু গর্ভবতী নারীরাই পেয়ে থাকেন।
এখন দেশের গ্রামাঞ্চলের গর্ভবতী নারীদের তালিকা ও মুঠোফোন নম্বর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের কাছে থাকে। কেন্দ্রীয়ভাবে সেসব মুঠোফোন নম্বর অধিদপ্তরের আইইএম শাখায় থাকে। আইইএম শাখা সেসব নম্বর পাঠায় কল সেন্টারে।
কল সেন্টারের কর্মকর্তারা বলেছেন, জেলা ধরে ধরে গর্ভবতী নারীদের কাছে ফোন করা হয়। কল সেন্টার এজেন্ট ফোন করেন ৪৫ জনকে, চিকিৎসক ফোন করেন ৪৫ জনকে। প্রতিদিনের লক্ষ্যমাত্রা ৯০ জনকে ফোন করা।
ওই সব নারীর কাছে ফোন করে কত দিনের গর্ভধারণ, স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, এ পর্যন্ত কতটি প্রসবপূর্ব সেবা নিয়েছেন—এসব তথ্য জানতে চাওয়া হয়। গর্ভবতী নারী কোনো সমস্যার কথা জানালে তাঁকে করণীয় বলে দেওয়া হয়।
কল সেন্টারের কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের ফোন পেয়ে অনেক গর্ভবতী মা বিস্মিত হন, অনেকে আনন্দ প্রকাশ করেন। অনেকের সেবা নেওয়ার আগ্রহ বেড়ে যায়।
স্পর্শকাতর সময়ের মধ্য দিয়ে যায় কিশোর-কিশোরীরা। এই সময়ে শরীরে পরিবর্তন আসে। নানা প্রশ্ন জাগে মনে। এই সময় দরকার সঠিক তথ্য, সঠিক পরামর্শ। অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন করার উপযুক্ত মানুষ খুঁজে পায় না। তারা জানে না কার কাছে সঠিক পরামর্শ পাওয়া যাবে। লজ্জা-ভয় ঝেড়ে ফেলে নিঃসংকোচে কথা বলার সেই সুযোগ করে দিয়েছে সুখী পরিবার কল সেন্টার। যেহেতু মুখোমুখি কথা বলতে হয় না, তাই মনের কথা কল সেন্টার এজেন্ট বা চিকিৎসকের কাছে বন্ধুর মতো অবলীলায় বলতে পারে কিশোর-কিশোরীরা। কল সেন্টার তাদের নাম-পরিচয় বা ফোন নম্বর প্রকাশ করে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। এটি বিশেষভাবে কাজে লাগছে কিশোর-কিশোরীদের, যারা কিছু কথা গোপনে বলতে চায়। তবে কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা দরকার। অন্যদিকে অধিদপ্তরের উচিত কেন্দ্রটির পরিচিতি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া, যেন বহু মানুষ সেবা নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।’