আমদানিকারকেরা পণ্য খালাস না নেওয়ায় বছরের পর বছর পড়ে থেকে কনটেইনারের লোহার ছাদ খসে পড়েছে। প্লাস্টিকের জারে থাকা অ্যাসিডের উপরিভাগের রং বদলে গেছে। বিপজ্জনক হয়ে ওঠা অ্যাসিডের এই কনটেইনার থেকে মঙ্গলবার দুপুরে হঠাৎ ধোঁয়া বের হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত চট্টগ্রাম বন্দরকর্মীরা কনটেইনারটি সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নেন।
এতে আপাতত ঝুঁকিমুক্ত হলেও এই অ্যাসিডবাহী কনটেইনারের মতো বিপজ্জনক পণ্যের কনটেইনারগুলো ২ থেকে ২৮ বছর পর্যন্ত পড়ে আছে চট্টগ্রাম বন্দরে।
কনটেইনার ছাড়াও শেডে আছে রাসায়নিকসহ ৩৭৬ টন বিপজ্জনক পণ্য, যার মধ্যে ৪৭ টন নিলামে তোলার জন্য কাস্টমসকে হস্তান্তর করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের তালিকায় দীর্ঘদিন পড়ে থাকা বিপজ্জনক পণ্যের কনটেইনারে রয়েছে নাইট্রিক অ্যাসিড, সালফিউরিক অ্যাসিড, প্রোপাইনিক অ্যাসিড, অক্সিজেন সাপ্লিমেন্ট ইত্যাদি। এর মধ্যে একটি কনটেইনার আমদানি হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। আর বেশির ভাগ কনটেইনার আমদানি হয়েছে এক দশকের মধ্যে। এসব কনটেইনারের আমদানিকারকের নাম পাওয়া যায়নি। কাস্টমস দফায় দফায় নিলামে তুলে বিক্রি ও ধ্বংস করলেও কমছে না বিপজ্জনক পণ্য। আমদানিকারকেরা খালাস না নেওয়ায় এ সমস্যা তৈরি হয়েছে।
সীতাকুণ্ডে গত শনিবার রাতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন থেকে বিস্ফোরণে ৪৩ জন নিহত হয়েছেন। আগুনের তাপে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড নামের রাসায়নিকের কনটেইনার বিস্ফোরণে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ডিপোটি। সীতাকুণ্ডের ঘটনার পর আবারও বিপজ্জনক পণ্য অপসারণে তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
সীতাকুণ্ডের মতো বন্দরে বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটলেও বিপজ্জনক পণ্যের কনটেইনার থেকেও আগুন ও বিস্ফোরণের নজির আছে। গত ১৩ মে বন্দর চত্বরে থাকা ব্যাটারি ও ইলেকট্রনিক পণ্যবাহী একটি কনটেইনারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে ব্যাটারি পণ্য ও ইলেকট্রনিক পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর আগে ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল রাতে বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল চত্বরে কনটেইনার খুলে কাভার্ড ভ্যানে মিথানলভর্তি ড্রাম বোঝাই করার সময় হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে চারজন শ্রমিক আহত হন। তাঁদের শরীরের সামান্য অংশ পুড়ে যায়। আহত ব্যক্তিরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেন। আবার একই বছর নাইট্রিক অ্যাসিডভর্তি চারটি কনটেইনার থেকে ধোঁয়া নির্গত হয়ে আতঙ্ক ছড়ায় বন্দরে।
আগে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটলেও মূলত সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের পরদিন ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বন্দর কর্তৃপক্ষ কাস্টমসকে চিঠি দেয়। তাতে বিপজ্জনক পণ্য আছে, এমন জরাজীর্ণ ৫৯টি কনটেইনার ধ্বংস বা নিলামে তুলে অপসারণের কথা বলা হয়। এর পরদিন হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডের দুটি কনটেইনার নিলামে তুলে বিক্রি করে কাস্টমস। মঙ্গলবার আরেকটি চিঠি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরকে ঝুঁকিমুক্ত করতে এসব কনটেইনার ধ্বংস বা নিলামে বিক্রি করে অপসারণ করা দরকার। সে জন্য কাস্টমকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
কাস্টমসকে পাঠানো বন্দর কর্তৃপক্ষের চিঠিতে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন পড়ে থাকা বিপজ্জনক পণ্যের কনটেইনারের কারণে বন্দরের পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বন্দর স্থাপনা, জানমাল ও পরিবেশ এবং অগ্নিঝুঁকি রোধকল্পে এসব পণ্য নিলামে তুলে বিক্রি বা ধ্বংস করা দরকার।
বন্দরে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা পণ্য অপসারণের দায়িত্বে থাকা কাস্টমসের উপকমিশনার মো. আলম আমিন প্রথম আলোকে বলেন, বৈরুতের ঘটনার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বিপজ্জনক পণ্য ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রতি মাসেই দুবার নিলামে তুলে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এখন প্রতি শনিবার বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে অন্তত ১০০টি করে কনটেইনার ইনভেন্ট্রি বা সরেজমিন দেখে পণ্যের বর্ণনা তুলে রাখা হচ্ছে, যাতে এসব কনটেইনার নিলামে দেওয়া যায়।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, গত এক বছরে সাড়ে ৩০০ কনটেইনার পণ্য ধ্বংস করা হয়েছে। রাসায়নিকসহ বিপজ্জনক পণ্য ধ্বংস করা হয়েছে ৭৭ টন।
আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত ‘ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস বা আইএমডিজি কোড’ অনুযায়ী বিপজ্জনক পণ্যের ৯টি ক্যাটাগরির তালিকা রয়েছে। তাতে বিস্ফোরক, বিপজ্জনক গ্যাস, দাহ্য তরল ও কঠিন পদার্থ, বিষাক্ত, তেজস্ক্রিয় পদার্থ রয়েছে। এ ছাড়া রাসায়নিক, সার, শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামাল, বর্জ্য তেলসহ এ তালিকায় বিপুলসংখ্যক পণ্য রয়েছে। সাধারণত অন্য পদার্থের সংস্পর্শে এলে এসব পণ্য স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির কারণ হতে পারে। সে জন্য এসব পণ্য পরিবহন থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত সতর্কতা মেনে চলতে হয়। ২০২০ সালে লেবাননের বৈরুতের ঘটনার পর বন্দরে পড়ে থাকা বিপজ্জনক পণ্য অপসারণ বা ধ্বংসের সুপারিশ করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অথরিটি ফর কেমিক্যাল উইপনস কনভেনশন।
আমদানিকারকেরা পণ্য খালাস না নেওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক। পণ্য আমদানি করে দিনের পর দিন ফেলা রাখা কোনোভাবেই উচিত নয়। কারও কাগজপত্রে সমস্যা থাকলে তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এর বাইরে যারা দিনের পর দিন কনটেইনার খালাস করবে না, তাদের কনটেইনার দ্রুত নিলামে তুলে বিক্রি করা উচিত। এতে শুধু ঝুঁকিই কমবে না, বন্দরের সক্ষমতাও বাড়বে।