চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে ৪৯ জনের প্রাণহানির পর বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নজরে এনেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। দুর্ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর আগেই নিরীক্ষা আপত্তি জানিয়ে আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা বলেছিল, বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে মানছে না বাংলাদেশ। এরপর শুধু চিঠি চালাচালি আর আলোচনা সভা করে কেটে গেছে দীর্ঘ সময়।
গত ৪ জুন বিএম ডিপোতে আগুন থেকে বিস্ফোরণে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক। হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড নামের রাসায়নিকের কনটেইনার বিস্ফোরণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এ দুর্ঘটনার পর বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির বিষয়টি সামনে আসে। যদিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও চট্টগ্রাম বন্দরের পৃথক দুটি নীতিমালা অনুযায়ী, বেসরকারি ডিপোতে বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা প্রণীত আইএমডিজি কোড মেনে চলা বাধ্যতামূলক।
দুর্ঘটনার পর গত ৭ জুন প্রথম আলোতে প্রথম পৃষ্ঠায় ‘বিপজ্জনক পণ্য তদারকিতে ঘাটতি থাকছেই’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশ বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার নিয়মকানুন যথাযথভাবে মানছে না জানিয়ে ২০১৭ সালে নিরীক্ষা আপত্তি তোলে আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা। নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য একটি ‘ন্যাশনাল কমপিটেন্ট অথোরিটি’ গঠনে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে সংস্থাটি। নিরীক্ষা নিষ্পত্তির সময়সীমা দেওয়া হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
*বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনায় পাঁচ বছর আগে নিরীক্ষা আপত্তি তুলেছিল আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা*নিরীক্ষা আপত্তির পরে চিঠি চালাচালি আর আলোচনা সভা করেই কেটে গেছে দীর্ঘ সময়*সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার নিরীক্ষা আপত্তির পর কমপিটেন্ট অথোরিটি গঠন ও এর কার্যক্রমবিষয়ক একটি প্রস্তাব তৈরি করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। এরপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নৌ মন্ত্রণালয়ে এ প্রস্তাব পাঠানো হয়। পরে আরও কিছু বিষয়সহ ২০২১ সালের জুনে আবারও প্রস্তাব পাঠানো হয়। বিষয়টি নিয়ে গত বছরের জুনে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে তৎকালীন সচিবের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভার আলোকে তৃতীয় দফায় গত বছরের ২৪ জুন আরেকটি প্রস্তাব নৌ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় নৌপরিবহন অধিদপ্তর।
সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের ঘটনার পর এবং প্রথম আলোর প্রতিবেদন প্রকাশের পর নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে চতুর্থ দফায় গত ১২ জুন আবারও নৌ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় নৌপরিবহন অধিদপ্তর। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর এ চিঠি দেন। চিঠির ভাষ্য মোটামুটি এ রকম, নিরীক্ষা আপত্তি নিষ্পত্তির সময়সীমা অতিক্রম করার পরও কমপিটেন্ট অথোরিটি বাস্তবায়ন হয়নি। অতি সম্প্রতি সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণ বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটি উন্মোচন করেছে, যা দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কমপিটেন্ট অথোরিটি গঠনের বিষয়ে অগ্রগতি হচ্ছে। এ–সংক্রান্ত বিষয়ে কার্যপত্র তৈরি করতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, অগ্রগতি হচ্ছে। আগামী সপ্তাহে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একটি সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে।
আন্তর্জাতিক নৌসংস্থার কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করলে তা মানা যেকোনো দেশের জন্য বাধ্যতামূলক। সাগরে জীবনের নিরাপত্তাবিষয়ক সোলাস (সেফটি অব লাইফ অ্যাট সি) কনভেনশনের আওতায় বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস বা আইএমডিজি কোড’ আছে। ২০০৪ সাল থেকে এ কোডের নিয়মকানুন মানা বাধ্যতামূলক। এ কোডের আওতায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয় ২০১০ সাল থেকে।
এ কোডের আওতায় নয়টি ক্যাটাগরির পণ্যের একটি তালিকা রয়েছে। তাতে রাসায়নিক, বিস্ফোরক, বিপজ্জনক গ্যাস, দাহ্য তরল ও কঠিন পদার্থ, বিষাক্ত, তেজস্ক্রিয়, জারণ পদার্থসহ আরও অনেক পণ্য রয়েছে। সাধারণত অন্য পদার্থের সংস্পর্শে এলে এসব পণ্য স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির কারণ হতে পারে। সে জন্য এসব বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে সংরক্ষণে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তার নীতিমালা আছে আইএমডিজি কোডে।
বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, শিল্পায়ন বাড়তে থাকায় বিপজ্জনক পণ্য আমদানি ও রপ্তানি বাড়ছে।
সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে কোনোভাবেই আর অবহেলা করা উচিত নয়। বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।