আমার শহর

সিলেট দর্শন

কোনো জনপদের মানুষ ও সমাজ নিয়ে, তাদের চারিত্র–বৈশিষ্ট্য এবং ভাবনাচিন্তা নিয়ে স্বল্প পরিসরে কিছু লেখাটা বিপজ্জনক। তাতে সামান্যীকরণের, হাত-পা-শুঁড় হাতড়ে হাতি দেখার মতো ভ্রান্তির একটা আশঙ্কা থেকে যায়। আর জনপদটা যদি হয় সিলেটের মতো এক বিস্তীর্ণ এবং প্রাচীন ভূগোল, তাহলে যতটা তার সম্পর্কে বলা হবে, তার থেকে বেশি না বলা থেকে যাবে। তবে যিনি লিখছেন, তিনি যদি ভেতরবাসী হন, যদি এর বাতাসে তিনি প্রথম নিশ্বাসটি নিয়ে থাকেন, তাহলে একটা অন্তর্দৃষ্টির সুবিধা তিনি পেয়ে যান, তাতে ভ্রান্তির মাত্রাটা কমে যায়।

লেখার শুরুতেই আমার স্বীকারোক্তি, সিলেটকে জানা আমার ফুরাবে না। এর পুরো ভূগোলটাই যেহেতু দূর থেকে দেখা, কোনো হাওরের মতো—শান্ত, নিস্তরঙ্গ। কিন্তু কাছে গেলে, এর জীবনে ঢুকে পড়লে বোঝা যায়, অনেক কোমলের সঙ্গে কিছু কঠোরও আছে, অসতর্কদের জন্য যা বিপদ ডেকে আনতে পারে। সিলেটের ডিএনএতে এই কঠোর-কোমলের সহ-অবস্থান আছে। স্রোতের প্রতিকূলে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। বহুদিন আসামের সঙ্গে ছিল জেলা/বিভাগটি, দাপটের সঙ্গেই ছিল, সিলেটের প্রান্তসীমা থেকে নির্বাসিত হয়ে। আবার ১৯৪৭-এ গণভোটের আয়োজন করে সেই নির্বাসন ঘুচিয়েওছে, র‌্যাডক্লিফের কাঁচিকে উপহাস করে নিজের অধিকারটা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু বাংলায় ফিরলেও নিজের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে চেয়েছে। কিছুটা উন্নাসিকতা দেখিয়ে বলেছে, ‘আমি ছিলটি, আফনারা বেঙ্গলি।’ অনেক দিন—এখনো নিশ্চয়, কোনো কোনো পরিবারে অন্তত—সিলেটের বাইরের কোনো ছেলে বা মেয়েকে কেউ বিয়ে করলে বলা হতো, ‘বেঙ্গলি বিয়া করছে।’ একাত্তরে এই সিলেটই জ্বলে উঠল, অসমসাহসে যুদ্ধ করল নিজেদের আকাশে লাল–সবুজ পতাকা ওড়ানোর স্বাধীনতার জন্য এবং এই যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এবং দ্বিতীয় প্রধানজনও এলেন সিলেট থেকে।

সিলেটিরা গর্ব করে নিজেদের ভাষা, নাগরী ভাষা নিয়ে, যে ভাষার একটা বিজ্ঞানসম্মত নিজস্ব লিপি আছে এবং দীর্ঘদিন এই ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়েছে। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই যখন বাংলা ভাষা বিপন্ন হলো, তার পক্ষে এই জেলার সবাই পথে নামল। সেই ১৯৪৮ সালে সৈয়দ মুজতবা আলী, যিনি ছিলেন কমলালেবুর ঘ্রাণ মেশানো সিলেটি ভাষার একজন গর্বিত চর্চাকারী, বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে শক্তিশালী একটি লেখা লিখলেন। বায়ান্ন সালে সিলেটের নারীরাও ভাষার প্রশ্নে পথে নেমেছিলেন—সিলেটের রক্ষণশীলতা তাতে বিচলিত হয়নি। ভাষার অধিকার বলে কথা।

কূল-প্রতিকূলের দ্বন্দ্ব আরও আছে। সমুদ্র থেকে কয়েক শ মাইল দূরের এই ভূগোল থেকে দূরগামী নাবিকেরা বেরিয়েছেন, কোন রসায়নের বলে, কে জানে। যে ভূগোলের ভাটির এক বাউল বলেছেন, ‘গ্রাম ছেড়ে যে দূর পথে যায়, নিকটজন সে না ফিরে পায়,’ সেই ভাটিরই জলবন্দী গ্রামের ছেলেরা লন্ডন গিয়ে বাংলা টাউন গড়ে তুলেছেন। সিলেটের মতো ভ্রমণপিপাসু মানুষ কম দেখা যায়, অথচ এই ভূগোলের মানুষের এক চারিত্র-বৈশিষ্ট্য কিনা আলস্য! অবাক বৈপরীত্য!

সিলেটিদের সমুদ্রযাত্রা আর ইংল্যান্ডে থানা গাড়ার ইতিহাসটি উত্তর-উপনিবেশী তত্ত্বের আলোয় একটা প্রতিরোধ হিসেবেও দেখা যায়। ১৯৫০–এর দশক থেকে শুরু হওয়া ইংল্যান্ডের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্তি ছিল সিলেটের মানুষজনের। শুরুতে রেস্টুরেন্টের নামে ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিচালনায় থাকত ভারত-নির্ভরতা, ইংরেজদের কাছে তাদের পরিচিতি যেহেতু ব্যাপক ছিল, কিন্তু পাচক-রন্ধনশিল্পীর বেশির ভাগ ছিলেন সিলেটের। একাত্তরের পর থেকে এটি আস্তে আস্তে বদলাতে থাকে। এখন তো ‘কচি কলাপাতা’ নামের রেস্টুরেন্টও আছে। হেঁশেলে সিলেটিদের আধিপত্য যে খাদ্য সংস্কৃতি তৈরি করল, তার প্রভাব পড়ল ইংল্যান্ডের খাদ্যাভ্যাসে, আহার পছন্দের ক্ষেত্রে। এখন ‘কারি’ হচ্ছে ইংল্যান্ডের জাতীয় খাদ্য; প্রায়। এই বদলে দেওয়াটাকে কি বলা যায় না দ্য এম্পায়ার কুকস ব্যাক? অর্থাৎ রান্না করে প্রান্তকে উপনিবেশকারীর কেন্দ্রে ঢুকিয়ে দেওয়ার মসলাযুক্ত বিপ্লব? লন্ডনের সিলেটি রেস্টুরেন্ট আমাকে এই জেলা/বিভাগের আরেক বৈপরীত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। প্রতিটি রেস্টুরেন্টের হেঁশেল কর্তা—শেফ—পুরুষ, অথচ নিজেদের গ্রামের বাড়িতে তাঁরা রান্নাঘর থেকে নিরাপদ দূরত্বেই থাকেন। কেন এমনটা হয়, আমি এক শেফকে তা জিজ্ঞেস করলে তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘ইকান অইল কামোর জায়গা, হিকান অইল বাড়ি।’ বুঝলাম। কিন্তু তাঁর কথা শেষ হয়নি। বাড়িতে রান্নাঘর মেয়েদের, বাইরেটা পুরুষের, তিনি বললেন। তাও বোঝা গেল। কিন্তু শেষ যে কথাটি তিনি বললেন, তা আমার মনঃপূত হলো—‘বাড়িত গেলে খালি কুড়ামি লাগে।’

সিলেটের রান্নার সুনাম আছে। আখনি নামের অনেকটা তেহারি ঘরানার সুখাদ্যের কথাই ধরুন, ভূভারতে যার জুড়ি মেলা ভার। আখনিকে আমি নির্দ্বিধায় সিলেটের ‘জাতীয়’ খাবার বলব। রোজার মাসে আখনি ছাড়া ইফতার অসম্পূর্ণ থাকে। সিলেটের খাদ্য সংস্কৃতিতে আছে সাতকরা (‘হাতকরা’) আর লাইশাক, যা দেশের অন্য কোথাও জন্মায় না। সিলেটে ভালো মিষ্টি হয় না বলে অনেকের অভিযোগ, তবে হালুয়া যে হয় অপূর্ব, কজন তা জানেন। সিলেটে বানানো মাসকাতি হালুয়া মাসকাতেও এত ভালো হয় কি না, সন্দেহ।

আখনি তাহলে কেন কাচ্চি বিরিয়ানির মতো খ্যাতি পায়নি? পায়নি কারণ ওই আলস্য। নিজেদের ঢোল পেটাতেও সিলেটিদের আলস্য। ভাটির বাউলরা যে অমূল্য সব সৃষ্টি উপহার দিয়েছেন, তা নীরবেই করেছেন, অন্যেরা তা খুঁজে নিয়েছে। বাউলদর্শনের ভিত্তি হচ্ছে নিজেকে খোঁজা। নয়নে নয়নে আপনার রূপ দেখা।

নিজেদের ঢোল পেটাতেও সিলেটিদের আলস্য। ভাটির বাউলেরা যে অমূল্য সব সৃষ্টি উপহার দিয়েছেন, তা নীরবেই করেছেন, অন্যেরা তা খুঁজে নিয়েছে। বাউলদর্শনের ভিত্তি হচ্ছে নিজেকে খোঁজা।

সিলেটের ভেতরবাসী না হলে আলস্যের মাত্রা ও প্রকৃতিটা বোঝা যায় না। ছোটবেলায় দেখতাম, আমার শহরটার জীবনে তাড়াহুড়া নেই। বাজারে হুলুস্থুল নেই। ক্রেতা-বিক্রেতার লেনদেন হচ্ছে কিন্তু কেউ একজন গল্প জুড়ে দিলে ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে যেত। গল্প বলায় সিলেটিরা ওস্তাদ। শোনাতেও। এ দেশের আর কোনো শহরে সকাল ১০টায় পুঁথি পাঠক তাঁর গল্পের পসরা নিয়ে শহরকেন্দ্রে হাজির হন, আর বয়ান শুরুর কয়েক পলকের মধ্যে শ্রোতাদের সময়টা অধিকার করে নেন? আমার শৈশবের পুঁথি পাঠক বেছে নিতেন আলী আমজাদের ঘড়িঘরের ছায়া। ওই ঘড়ির কাঁটা দুটিও অলস ঘুরত। খুব কমই সঠিক সময় দিতে দেখেছি এই আইকনিক ঘড়িটাকে। সিলেটি ভাষাটাই তো আয়েশি একটা ভাষা—স্বরের উত্থান-পতন তেমন নেই, মহাপ্রাণ ধ্বনি নেই, শ্বাসাঘাতের তাড়া নেই। বরং স্বরবর্ণগুলো সুরমার মতো বয়ে যায়। কেউ যদি একটা বর্ণনা শুরু করেন, স্মৃতির অথবা দিনের বাস্তবের, বলার ভঙ্গিতে গল্পের আয়েশ ঢুকে যায়। ‘তার পরে কিতা অইল হুনো বা’—তিনি বলতে থাকেন। না শুনে কি পারা যায়? জেলা জজের আদালতের বাইরে দুই উকিলকে শুনেছি এভাবে একটা মামলার বুক-পিঠ নিয়ে কথা বলছেন। অথচ এই সিলেটের এক জনপ্রিয় উপদেশ: ‘করলে কাম শরবৎ, না করলে কাম পর্বত’। উপদেশটা কে কবে চালু করেছিলেন, জানি না, খনার মতো ক্ষণজন্মা কেউ নিশ্চয়, যিনি আলস্য অপছন্দ করতেন। নাকি অবেলাতে দিনদুপুরের মধ্যখানে ছুটি নিতে পছন্দ করে আমার মতো অলস যেসব মানুষ, তাদের কাজে ফেরানোর এটি কোনো করপোরেট মন্ত্র?

সিলেট নিয়ে কথা বলতে গেলে বর্তমান-অতীতের একটা সীমারেখা টানতে হয়। অতীতে, মানে ৫০–৬০ বছর আগেও যেসব ঐতিহ্য জীবন্ত ছিল, যেসব নীতি ও মূল্যবোধ মানুষকে পথ দেখাত, সেসব এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। দুটি চর্চার কথাই ধরা যাক। একটা সম্প্রীতির, আরেকটা রাজনীতির। সিলেটে সব ধর্মের অনুসারীরাই আছেন, তাঁরা নিজেদের উৎসব করেন। আগে কোনো উৎসব ঘিরে সংঘাত হয়েছে, মনে করা কঠিন। আমার পাড়ায় মসজিদ ছিল, নিম্বার্ক আশ্রম নামে সনাতন ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল, মণিপুরি মণ্ডপ ছিল এবং সম্প্রীতি ছিল। সিলেটের রাজনীতি পুরোনো, রাজনীতির সঙ্গে দায়িত্বশীলতা এবং ত্যাগের যে একটা সংযোগ আছে, জনসেবারও, সেই বোধটাও পুরোনো। এ জন্য সিলেটের রেজিস্টারি মাঠে একদিন এক দল জনসভা করেছে, আরেক দিন অন্যদল। সমস্যা হয়নি। রাজনীতি নিয়ে কোলাহল হয়েছে, কলহ হয়নি। এ জন্য কি না, সিলেটকে বাংলাদেশের রাজনীতির আবহাওয়া-সংকেত বলা হয়। সেই সংকেতের ভালো দিকটা এখন উপেক্ষিত, যদিও বাস্তব ও পরিসংখ্যানগত দিকটা ঠিকই আছে। ধরে নেওয়া হয় যে দল সিলেট-১ আসনে জিতবে, দেশের ক্ষমতা তার। এ জন্য কি না, প্রতিটি দলের নির্বাচনী প্রচার শুরু হয় নেতা-নেত্রীদের হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে। কিন্তু এখন কলহই প্রবল, যেমন সম্প্রীতি প্রশ্নবিদ্ধ।

এখন ভাষার ম্যাকডোনাল্ডধর্মী প্রবণতা সিলেটি জবানেও পরিবর্তন ‌এনেছে। সর্বত্র একই স্বাদের ম্যাকডোনাল্ড বার্গারের মতো বাংলা ভাষার সব আঞ্চলিক প্রকাশও এখন একই রূপ ধরতে যাচ্ছে। এর পেছনে দৃশ্যমাধ্যমের উৎসাহ আছে, করপোরেট চালাকিও আছে—যেহেতু সবাই এক ভাষায় কথা বললে বাজারটা সুষম হয়, মুনাফা উপচে পড়ে। কিন্তু আমি চেষ্টা করি জবানটা ধরে রাখতে। সে জন্য বেখাপ্পা কাউকে দেখলে ভাবি, ‘বগডুল’ (তালুত নাই চুল, পেটো গন্ডগুল, তার নাম বগডুল); অবিবেচক অথচ রাগী মানুষ দেখলে মনে মনে বলি, ‘চুকুমবুধাই’, অসময়ে ক্ষুধা লাগলে একটু ‘হাদালুভা’ খাই। এই সব।

সম্প্রীতি ফিরবে কি না জানি না। রাজনীতি...। থাক, রাজনীতি নিয়ে যত কম বলা হবে, ততই ভালো। তবে সিলেটকে সিলেট হয়ে থাকতে হলে আপন দর্শনের চর্চা করতে হবে, এর বাতাসে কমলালেবুর গন্ধ আর ভাটির সুর ফিরিয়ে আনতে হবে, এর জীবন টানা ১০ দিনের বৃষ্টির মন্দ্রতা দিয়ে সুস্থির করতে হবে।

আমার ছেলেবেলায় সিলেট এমনটাই ছিল।

● সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, লেখক ও শিক্ষাবিদ