একটি চক্রের (সিন্ডিকেট) দুর্নীতির কারণে সাড়ে তিন বছর ধরে বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। নতুন করে বাজার খোলার সময় আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে সেই চক্র। এ শ্রমবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা জোর তৎপরতা চালাচ্ছে।
অবশ্য এতে সায় দিচ্ছে না বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তাই এখন মালয়েশিয়া থেকে একচেটিয়াভাবে শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।
সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ রেখেছে এ চক্র। রাষ্ট্রের চেয়ে ২৫ এজেন্সির ক্ষমতা বেশি, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।তাসনিম সিদ্দিকী, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার, রামরু
রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের একাধিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় সায় না দিলেও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সিন্ডিকেট ঠেকানোর পথেও হাঁটছে না। বরং দায় এড়ানোর কৌশলে এগোচ্ছে তারা। মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা নিজেরা না করে মালয়েশিয়া সরকারের হাতে দায়িত্ব দিতে চাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এতে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণেই চালু হবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির বিষয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক সই হয়। এখন শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি সব রিক্রুটিং এজেন্সির জন্য উন্মুক্ত না রেখে ২৫টিকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি বলছে মালয়েশিয়া। গত ১৪ জানুয়ারি প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীকে দেওয়া একটি চিঠিতে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান বলেন, ২৫টি মূল এজেন্সি ও প্রতিটির সহযোগী (সাব-এজেন্ট) হিসেবে ১০টি করে এজেন্সি রাখার বিষয়ে দুই দেশ গত বছরের ফেব্রুয়ারির বৈঠকে সম্মত হয়েছে।
জনশক্তি রপ্তানির বিষয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়।দেশে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা ১,৫২০টি।শ্রমিক পাঠানোর বিষয়টি সবার জন্য উন্মুক্ত না রেখে ২৫টিকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলছে মালয়েশিয়া।
জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কোনো সংখ্যা সমঝোতা স্মারক নেই। মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ রাজি হয়নি।
মালয়েশিয়া নির্দিষ্ট এজেন্সির তালিকা করলে মানবেন কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘১ হাজার ৫২০ এজেন্সি থেকে কীভাবে বণ্টন করা হবে, এটা ওদের (মালয়েশিয়া) ব্যাপার। ওনারা যদি সীমিত করার দিকে যান, তাহলে প্রতিযোগিতা আইনে আমরা ধরা খাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে এখন পর্যন্ত সিন্ডিকেটের কোনো প্রস্তাব আসেনি। এলে তা নিয়ে যৌথ কারিগরি কমিটির সভায় আলোচনা হবে।’
এদিকে মালয়েশিয়ার মন্ত্রীকে ১৮ জানুয়ারি পাল্টা একটি চিঠি পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সনদ ও বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইন-২০১২-এর কথা উল্লেখ করে নির্দিষ্ট কিছু এজেন্সিকে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা তুলে ধরা হয়।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ১ হাজার ৫২০টি এজেন্সির তালিকা পাঠানোর পর মালয়েশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। দেশটি অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্দিষ্ট এজেন্সিকে সুযোগ দিলে তাতে আপত্তি জানাবে না প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
বিষয়টি নিয়ে আটটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, সব মিলিয়ে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই যে একটি চক্রকে অবাধে বাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
রিক্রুটিং এজেন্সিজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি টিপু সুলতান বলেন, মালয়েশিয়াকে তালিকা করার সুযোগ দিলে মূলত চক্র তৈরিতে সহায়তা করা হবে।
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে নেপাল কী নিয়ম অনুসরণ করে, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল দেশটির সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শোম লিউটেলের কাছে। অভিবাসন নিয়ে কাজ করা এই আইনজীবী প্রথম আলোকে বলেন, দেশটিতে ৮৫৮টি রিক্রুটিং এজেন্সি কাজ করছে। সবার জন্য সমান সুযোগ আছে।
২০১৬ সালে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের অনলাইন কাঠামোর কাজটি পায় সিনারফ্ল্যাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক আবদুল বিন আমিন নূর এ প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাঁর সহযোগিতায় দেশের ১০টি এজেন্সি মিলে তৈরি হয় চক্র। চক্রটি তখন সরকার নির্ধারিত ৩৩ হাজার ৩৭৫ টাকার বদলে শ্রমিকদের কাছ থেকে দুই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা আদায় করে।
বিষয়টি নিয়ে আটটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, সব মিলিয়ে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে এই যে একটি চক্রকে অবাধে বাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রার সূত্র বলছে, এবারও মালয়েশিয়া থেকে চক্র তৈরিতে সহায়তা করছেন আবদুল বিন আমিন। বাংলাদেশে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক রুহুল আমিন। অবশ্য তিনি দাবি করেন, তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের একাধিক সংগঠন চক্র তৈরির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, স্মারকলিপি দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের কর্মী ছাড়া কোনো উপায় নেই মালয়েশিয়ার সামনে। এ সুযোগ সরকারের কাজে লাগাতে হবে।
বিএমইটির তথ্য বলছে, ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বৈধভাবে কাজ নিয়ে মালয়েশিয়ায় গেছেন সাড়ে ১০ লাখ বাংলাদেশি।
অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী মনে করেন, চক্রে জড়িত এজেন্সির নাম বের করে তাদের লাইসেন্স স্থগিত করা উচিত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ রেখেছে এ চক্র। রাষ্ট্রের চেয়ে ২৫ এজেন্সির ক্ষমতা বেশি, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।