সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ আজ বুধবার কক্সবাজারে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তাঁরা পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের নিহত হওয়ার ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। কক্সবাজারের সেনাবাহিনীর বাংলো জলতরঙ্গে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা জোর দিয়ে বলেন, এতে দুই বাহিনীর সম্পর্কে চিড় ধরবে না।
আজ দুপুরে হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে আসেন সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ। বেলা পৌনে তিনটায় তাঁরা কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্ট এলাকায় সেনাবাহিনীর বাংলো জলতরঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন। শুরুতেই সেনাপ্রধান ও পুলিশপ্রধান পাঁচ মিনিট করে বক্তব্য দেন। প্রথমে বক্তব্য দেন সেনাপ্রধান।
সেনাপ্রধান বলেন, ‘কক্সবাজারে আসার উদ্দেশ্য হলো একটাই—সেটা হলো গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আমরা এখানে এসে এ এলাকার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং পুলিশ বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমি সেনাপ্রধান হিসেবে এবং জনাব বেনজীর সাহেব পুলিশপ্রধান হিসেবে মতবিনিময় করেছি, বক্তব্য দিয়েছি। আমরা তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। এখানে আসার উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং আজকে যে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক, সেটা অর্জনে এই দুই সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ পুলিশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করি। বিগত প্রায় ৫০ বছরে এই দেশে যে অগ্রগতি বা উন্নয়ন হয়েছে, ...নিরাপত্তার ঝুঁকিগুলো এসেছে, আমরা এ দেশের অন্যান্য সংস্থার ন্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি বাহিনী সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ—আমরা সব সময় যেকোনো প্রয়োজনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছি।’
জেনারেল আজিজ বলেন, ‘সাম্প্রতিক কালে যে করোনা যুদ্ধ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, করোনা যুদ্ধেও পুলিশের সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। যে ঘটনাটা হয়েছে, সেটা নিয়ে অবশ্যই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মর্মাহত এবং পুলিশ বাহিনীসহ সবাই মর্মাহত। তবে যে জিনিসটা আমরা এখানে আলোচনা করেছি, আপনাদের মাধ্যমে যে বার্তাটা দিতে চাই, আমরা এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে চাই। এবং যে ঘটনার আলোকে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশে একটি তদন্ত টিম গঠন করে দিয়েছে এবং তারা গতকাল (মঙ্গলবার) কাজ শুরু করেছে। আমরা সেটির প্রতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস এবং তদন্ত টিমের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। সেনাবাহিনীর আস্থা আছে, পুলিশ বাহিনীরও আস্থা আছে। আমরা আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটা জিনিস নিশ্চিত করতে চাই, যে ঘটনাটা ঘটেছে, এই ঘটনাটার সাথে যারা সম্পৃক্ত থাকবে, সেটার দায়দায়িত্ব কোনো প্রতিষ্ঠানের হতে পারে না। এবং সেটার জন্য তদন্ত টিম যাদের দোষী সাব্যস্ত করে, তারা সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবে। এখানে কোনো প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত করবে না, কারও পক্ষে যাবে না। আমরা আমাদের মধ্যে যে মিউচুয়াল ট্রাস্ট, কনফিডেন্স কো–অপারেশন, যে জিনিসগুলো অনেক বছরে তৈরি হয়েছে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে...। আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি যে এটাতে এমন কিছু সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে হবে না এবং পুলিশ বাহিনীর পক্ষেও হবে না। ঘটনা যেহেতু তদন্তাধীন আছে, আমরা সেটা নিয়ে অন্য কোনো কথা বলব না। আবারও বলছি, এই ঘটনা নিয়ে যাতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সম্পর্কে চিড় ধরানো বা ভুল–বোঝাবুঝির সৃষ্টি করার চেষ্টা কেউ না চালায়, সে জন্য সবাইকে অনুরোধ করব। আমাদের সবার চেষ্টা করা উচিত তদন্তটা যাতে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়, সে জন্য যে পরিবেশের প্রয়োজন—সামগ্রিকভাবে আপনারা সাংবাদিকেরাও সহযোগিতা করবেন। অবশ্যই আমরা, সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীও সহযোগিতা করবে। ...সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং যারা দোষী, তাদের বিচার হবে। সেটা যাতে ব্যাহত না হয়। আমরা এমন কিছু কেউ করব না। ধন্যবাদ।’
এরপর বক্তব্য দেন পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, ৫০ বছর ধরে একসঙ্গে কাজ করার রেকর্ড রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর। দুটি প্রতিষ্ঠানই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং এই দুটি বাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতার জন্য দায়িত্ব পালন করেছে। তিন মাসেরও অধিককাল ধরে করোনা যুদ্ধে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী মাঠপর্যায়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। দেশের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে মারাত্মক বন্যা পরিস্থিতি আছে, তার সঙ্গে করোনা ক্রাইসিসে সবাই মিলে মাঠপর্যায়ে একত্রে মোকাবিলা করছি। আমাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং আস্থার সম্পর্ক রয়েছে। এখানে যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমাদের লক্ষ্য হবে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তারা প্রভাবমুক্ত হয়ে তদন্ত করবে এবং তারা যে সুপারিশ ও পরামর্শ দেবে, সে অনুযায়ী পরবর্তী আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি আমরা বলতে চাই এটাকে নিয়ে অনেকে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলছে এবং দুই বাহিনীর মধ্যে...চেষ্টা করছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত দক্ষ, চৌকস। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কাজ করছি, মানুষের কল্যাণ, অর্থনীতির সমৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়ন আমরা যৌথভাবে বাংলাদেশ আর্মি ও বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করে যাব। এবং আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করব, আগামী দিনগুলোতে এই সম্পর্ক আরও স্ট্রং করতে হবে। এখানে যাঁরা উসকানিমূলক কথাবার্তা বলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছেন, তাঁরা যেমন সমর্থ হবেন না। পাশাপাশি আমরা বলতে চাই, এ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য দয়া করে এ ধরনের উসকানিমূলক কথাবার্তা বলবেন না। বাংলাদেশ একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশ, আমাদের দেশে রুলস অব ল রয়েছে, বিচার বিভাগ স্বাধীন। তো এখানে যদি কেউ কোনো অপকর্ম, বেআইনি কাজে লিপ্ত, তা…। এবং সেখানে কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। এ বিষয়ে যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছেন, তাঁরা সম্পূর্ণভাবে প্রভাবমুক্ত হয়ে তদন্তকাজ সম্পন্ন করবেন। আমরা অনুরোধ করব, দয়া করে বাহিনীবিরোধী, দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো উসকানি..., এবং যাতে করে এই দুর্যোগময় মুহূর্তে সংকটকালীন এবং দ্রুত সংকট কাটিয়ে উঠতে পারি, সেভাবে আমাদের সবাই সমর্থন করবেন, আমাদের সহায়তা করবেন।’
পরে সেনাপ্রধান বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সে জন্য আমরা সবাই সতর্ক থাকব এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, তার জন্য যা কিছু করণীয়, আমাদের উভয় বাহিনীর পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’
এরপর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। এই হত্যার ঘটনায় চলমান মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে কি না, সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, ‘এখানে পুলিশ কাজ করে, র্যাব-বিজিবি কাজ করে। এই মুহূর্তে অনেক জায়গায় সেনাবাহিনীও সম্পৃক্ত আছে। এ ধরনের ঘটনা, মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করি না এবং হওয়া উচিত না, হবেও না।’
একই প্রশ্নর জবাবে পুলিশপ্রধান বেনজীর বলেন, ‘এটার সঙ্গে মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেন মাদক ব্যবসায়ীরা তৎপর না হয়, সে ব্যাপারে সব বাহিনী কাজ করবে। আমরা চাই না কক্সবাজারে...মাদক আমাদের নেক্সট জেনারেশনের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার।...’
মেজর (অব.) সিনহার ও তাঁর সঙ্গী সিফাতের বিরুদ্ধে মাদকবিরোধী মামলা দায়ের প্রসঙ্গে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পুলিশপ্রধান বলেন, ‘এটা তদন্তের ব্যাপার। তদন্ত করে দেখা হবে। এবং তদন্তাধীন মামলার বিষয়ে আমরা কথা বলতে পারি না।’
ক্রসফায়ার আতঙ্ক প্রসঙ্গে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পুলিশপ্রধান বলেন, ‘এভাবে বলা ঠিক হবে না। আসলে আমরা ক্রসফায়ার শব্দের সঙ্গে একমত নই।’
কক্সবাজার সীমান্তে মাদক নিয়ন্ত্রণে র্যাব-বিজিবি–পুলিশ যৌথভাবে কাজ করছে। তারপরও মিয়ানমার থেকে মাদক আসে। মাদকের সঙ্গে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও জড়িত রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা আরও জোরদার করা হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, ‘যেহেতু আমি আগে বিজিবি প্রধান ছিলাম—দীর্ঘ প্রায় চার বছর—সে অভিজ্ঞতার আলোকে বলি, আসলে এ ধরনের বিষয়গুলো সীমান্তরক্ষী বাহিনী, প্রধানেরা তাদের মধ্যে যখন মিটিং হয়, তখন এসব বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়। এবং আমি নিশ্চিত আমাদের বিজিবি এবং মিয়ানমারের যে বর্ডার গার্ড পুলিশ আছে, তাদের মধ্যে বাৎসরিক বা ত্রৈমাসিক-ষাণ্মাসিক যে মিটিংগুলো করে, সেখানে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। এবং সেখানে বিভিন্ন করণীয় বিষয় আছে, সেগুলো তারা আলোচনা করে এবং সে অনুযায়ী তারা অ্যাকশন নেয়।...আসলে সবাই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে। তারপর ঘটনাগুলো ঘটছে। সেনাপ্রধান হিসেবে আমি এখানে একটা কথা বলব, এই মাদক বা এ ধরনের ঘটনাগুলোতে প্রতিরোধ করতে হলে সাংবাদিকদের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।’
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শেষে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ বিকেল চারটার দিকে মেজর (অব.) সিনহার নিহত হওয়ার ঘটনাস্থল দেখতে সড়কপথে মেরিন ড্রাইভ সড়ক হয়ে টেকনাফের বাহারছড়ার শামলাপুর পুলিশ তল্লাশিচৌকিতে যান। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা। দুই বাহিনীর প্রধানকে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন। এরপর সেনাপ্রধান ও পুলিশপ্রধান উপস্থিত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে পুনরায় কক্সবাজারে ফেরেন।