সফর শেষ করার আগে দিল্লি এবং সফর শেষে ঢাকায় ফিরে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দৃশ্যত তির্যক ভঙ্গিতে বলেন, ‘চাইলাম তিস্তার পানি, দিদি বললেন বাড়তি বিদ্যুৎ দেবেন’, তখনই বোঝা গেল অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিরিখে তাঁর এই সফর অতঃপর কোনো দাঁড়িপাল্লায় উঠতে চলেছে।
সেদিন শেখ হাসিনার কথা, ‘যাক, কিছু তো পাওয়া গেল’র মধ্যে একটা করুণ সুর যেন রিনরিন করে উঠেছিল। অনেকটা সেই ‘নাকের বদলে নরুন পেলাম’–এর মতো।
দিল্লি ছাড়ার আগেই হাসিনা সফরসঙ্গী শিল্পপতি–ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এবার আপনারাই বলুন দেশ বেচে দিয়ে দেশে ফিরছি, নাকি কিছু নিয়ে ফিরছি।’ সেটা ছিল সমালোচনাকারী ও বিরোধীদের ঢিলের জবাবে তাঁর পাটকেল। কিন্তু সেই উক্তির মধ্য দিয়ে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল, তাঁর এই সফরে সই হওয়া প্রতিরক্ষা চুক্তি ও সই না হওয়া তিস্তাই হতে চলেছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আবহ সংগীত।
অথচ এমনটা কিন্তু হওয়ার কথা নয়। কারণ, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক কিছুতেই স্রেফ তিস্তাকেন্দ্রিক নয়। সহযোগিতার সব ক্ষেত্রে গত আট–নয় বছরে সুন্দরভাবে এগিয়ে চলার ছবি জ্বলজ্বল করছে। সেই ক্যানভাসে আস্থা, ভরসা ও বিশ্বাসের পোঁচ ঝলমল করছে। তবু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সাধারণ মানসিকতা তিস্তাকে ছাপিয়ে বাকি অন্য কিছু গ্রাহ্য করতে প্রস্তুত নয়! তিস্তার বিকল্প তাদের কাছে আর কিছু হয়ে ওঠেনি। নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে পানি এবং আপাতত তা তিস্তারই পানি, দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে মাথা
তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফেলেছে এক গভীর ছায়া। তিস্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন এক অদ্ভুত প্রতীক! আর তাই তিস্তার বদলে তোর্সার পানি নেওয়ার মমতা–ময় বিকল্প প্রস্তাব বাংলাদেশের কোনো মহলেই হালে পানি পায়নি।
গত চার বছরে যতবার বাংলাদেশে গেছি, যত আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছি, যতজনের সঙ্গে নিভৃত আলাপচারিতা করেছি, সব জায়গায় সব ছাপিয়ে একটাই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠেছে, আপনারা কি তিস্তার পানি দেবেন না? সামাজিক মাধ্যমগুলো উপচে পড়েছে এই মন্তব্যে, ‘ইন্ডিয়া শুধু নিতে জানে, দিতে নয়!’ এবার শেখ হাসিনার সফরের পর এই মন্তব্যটা আড়ে–বহরে আরও বেড়ে ভারতের দিকে প্রবলভাবে ধেয়ে এসেছে। শেখ হাসিনার আমলের বহুমুখী উন্নয়ন সত্ত্বেও এই সফর আওয়ামী লীগকে রক্ষণাত্মক ও বিরোধী শিবিরকে আক্রমণাত্মক করে তুলেছে। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতারা চেয়ে রয়েছেন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কত দ্রুত কীভাবে রক্ষা করতে পারেন তার ওপর। শেখ হাসিনা পর্যন্ত সফর শেষে দেশে ফিরে সেই আশ্বাসের কথাই শুনিয়েছেন। হায়দরাবাদ হাউসে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে সেই আশ্বাস দিয়ে মোদি বলেছিলেন, তাঁর ও হাসিনার শাসনকালেই তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হবে।
বেলা বয়ে যাওয়ার মতো সময়ও এগিয়ে চলে। বাংলাদেশের সংসদের ভোট আসছে বছরের মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে। তার মানে, শেখ হাসিনার দলের হাতে রয়েছে বড়জোর আর দেড়টা বছর। এই সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করালে আওয়ামী লীগের পালে নিঃসন্দেহে একটা বাড়তি বাতাস বয়ে যাবে। না হলে শাসক দলকে সেই অপ্রাপ্তির মোকাবিলা করতে হবে।
মোদি সফল হবেন কি না, সেই উত্তর কিন্তু এখনো পর্যন্ত অজানা। জানা শুধু এই কথা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোভাব দিন দিন কঠোর হচ্ছে। বারবার তিনি তিস্তার পানি না দেওয়ার কথা শুনিয়ে যেমন যাচ্ছেন, তেমনই বাড়িয়ে চলেছেন বিজেপির সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক দূরত্ব। সেই দূরত্বে ক্রমশই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তিস্তা!
মমতা কিন্তু মোদিকে অন্য একটা রাস্তার সন্ধান দিয়েছিলেন; তাঁকে এড়িয়ে তিস্তা চুক্তিতে সই করার। এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মমতা তেমন একটা ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন। সেই রাস্তায় হাঁটার কোনো ইচ্ছা অবশ্য নরেন্দ্র মোদি এখন পর্যন্ত দেখাননি।
বাংলাদেশের বহু মানুষের মনেও এমন একটা দোলাচল যে নেই তা নয়। ভারতের সংবিধানও এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট। নদীর পানি রাজ্য তালিকাভুক্ত হলেও দেশের স্বার্থে যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি করার অধিকারী একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার। সে ক্ষেত্রে রাজ্যের ভূমিকা গৌণ। অর্থাৎ, মমতার আপত্তি উপেক্ষা করেই দিল্লি এই চুক্তিটা ঢাকার সঙ্গে করে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের প্রশ্ন, তাহলে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থে মোদি এটা করছেন না কেন?
করছেন না দুটো কারণে। প্রথম কারণ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধর্ম। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র–রাজ্য সহযোগিতার বিষয়টি বড় কথা। তাই মমতার সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
দ্বিতীয় কারণ ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। ২০১৯–এর ভোটে জিততে বিজেপির রাজনৈতিক দৃষ্টি ভারতের যে যে রাজ্যের ওপর লেপ্টে রয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সেগুলোর অন্যতম। এই রাজ্যের উত্তরে বিজেপি তার প্রাধান্য বিস্তার করেছে বেশ কিছুদিন। কোচবিহার, জলপাইগুড়িতে তারা জমি খুঁজে পেয়েছে। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে রয়েছে তাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী। জোর করে তিস্তা চুক্তিতে সই করলে মমতা রাজ্যজুড়ে বিজেপিবিরোধী যে প্রচার চালাবেন, তার মূল কথাই হবে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থের কথা ভাবে না। এই প্রচার বিজেপির পাকা ধানে যে মই দেবে না, তার গ্যারান্টি কী? বাংলাদেশের বন্ধুতা অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকা। তাই মোদি এখন পর্যন্ত কোনো ঝুঁকি নেননি।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা ভারতের দিক থেকে কতটা অর্থবহ ও প্রয়োজনীয়, সাউথ ব্লক তা বিলক্ষণ বোঝে। শেখ হাসিনার ক্ষমতায় না থাকার প্রভাব আগামী দিনে কতটা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে, নতুন করে পুরোনো চ্যালেঞ্জ কীভাবে খাড়া হতে পারে, দিল্লির জানা আছে তা–ও। পশ্চিম সীমান্তের মতো পূর্ব সীমান্তও অস্থিরতায় ভুগলে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের ঝুঁকি কী প্রবল, তা অনুমেয়। এ কথাও জানা, আগেরবারের মতো রাজনৈতিক ভুল আগামী ভোটে প্রধান বিরোধী দল করবে না। বিপুল উন্নয়ন সত্ত্বেও প্রতিটি স্তরে গোষ্ঠী কোন্দল শাসক দলের বলিরেখা গাঢ় করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কাছে তিস্তাই হয়ে উঠতে পারে সেই বিস্ময়কর জিয়নকাঠি। নরেন্দ্র মোদি যে তা জানেন না তা নয়।
এ কথা সত্য, ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় থেকে ২০১৭–এ শেখ হাসিনার ভারত সফর পর্যন্ত এই ছয় বছরে তিস্তা সমস্যার সমাধানে একবারের জন্যও কোনো জবরদস্ত তৎপরতা দেখা যায়নি। বাংলাদেশের অভিমানী হওয়ার কারণ তাই অসংগত নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তিনিও যে আদ্যন্ত ভারত–বন্ধু, এ নিয়ে লুকোছাপার কোনো অবকাশ শেখ হাসিনা কোনো দিন রাখেননি। দিল্লিকে তাই ভেবে দেখতে হবে, প্রকৃত বন্ধুতার স্বার্থে ও খাতিরে ভারত অতিরিক্ত কয়েক মাইল হাঁটার মতো বাড়তি কষ্টটুকু করবে কি না। সময় কিন্তু খুব বেশি আর নেই।