রাজধানীতে যাত্রীদের ভোগান্তি দূর করতে পাঁচ দিনেও পর্যাপ্ত বাস-মিনিবাস নামাতে পারেনি সরকার। এই অবস্থায় গতকাল বুধবার বাস-মিনিবাসের সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত ১৫ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
যদিও চলাচলের অনুমতির (রুট পারমিট) শর্ত অনুযায়ী, কোনো কারণ ছাড়া বাস-মিনিবাস বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। সেটা করলে রুট পারমিট বাতিলের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) আইন প্রয়োগ না করেই সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে কার্যত পিছু হটল।
গতকাল বিআরটিএ কার্যালয়ে পরিবহনমালিক, পুলিশ প্রতিনিধি ও বিআরটিএর কর্মকর্তারা বৈঠক করে ১৫ দিনের জন্য সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, সিটিং সার্ভিস নামে চললেও বাড়তি ভাড়া আদায় করা যাবে না, একই সঙ্গে যানবাহনের বাম্পার, হুক এবং অ্যাঙ্গেল খুলে ফেলার বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেন, যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী সিটিং সার্ভিসের একটি আলাদা কাঠামো তৈরি করা যায় কি না, তা পর্যালোচনা করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা পনেরো দিন পরে একটি বৈঠক করব। সেখানে সাংবাদিকেরাও তাঁদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন। সবাই যদি মনে করেন, সিটিং সার্ভিস হিসেবে একটি আলাদা কাঠামো দাঁড় করানো যায়, তাহলে তা করা হবে। সিটিং সার্ভিসকে একটা আইনের মধ্যে আনতে চাই।’
বাস মালিক সমিতির পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী রাজধানীতে গত শনিবার থেকে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করতে মাঠে নামেন বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই দিন থেকেই প্রায় ৪০ শতাংশ বাস-মিনিবাস রাস্তায় নামেনি। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ে যাত্রীরা। গতকাল দুপুর পর্যন্ত এই অবস্থা অব্যাহত থাকে। কিন্তু বিআরটিএর কার্যালয়ে গতকাল বিকেলে বৈঠক শুরুর পর বাস-মিনিবাস চলাচল বেড়ে যায়।
সাধারণ যাত্রী ও যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তিরা বলছেন, এবার ভাড়া কমানোর কথা বলে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা হয়। কিন্তু ভাড়া কমেনি। মূলত যাত্রীদের জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায়ের জন্য এটা মালিকদের কারসাজি।
বিআরটিএর কর্মকর্তা ও যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় সিটিং সার্ভিস অব্যাহত রাখার যে সিদ্ধান্ত গতকাল নেওয়া হয়েছে, তা অনেকটাই অবাস্তব। এর ফলে পরিবহনমালিকেরা বন্ধ বাস চালু করে দিতে পারেন। তবে বাড়তি ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য থেকেই যাবে। আর ভ্রাম্যমাণ আদালত সীমিত হলেও এত দিন বাড়তি ভাড়া আদায় রোধে যে তৎপরতা চালাচ্ছিল, গতকাল এই সিদ্ধান্তের কারণে শিথিল হয়ে পড়বে।
বিআরটিএ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে বের হয়ে একজন বাসমালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সিটিং সার্ভিস চালিয়ে ভাড়া কমানোর প্রশ্নই আসে না। তিনি মনে করেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের শিথিলতা থাকবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এর আগেও ২০ বছরের পুরোনো ও লক্কড়ঝক্কড় বাস-মিনিবাস বন্ধে অভিযান চালানো হয়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা মিটারে চলতে বাধ্য করতেও বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়েছে সরকার। এমনকি বাসের বাড়তি ভাড়া আদায় রোধেও একাধিকবার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে। অন্যদিকে প্রতিবারই যাত্রীদের জিম্মি করে মালিক-শ্রমিকেরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। যার ফলে মাঝপথে সরকার অভিযান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
গত মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সিটিং সার্ভিস বন্ধ এবং গত পাঁচ দিনের অভিযান পর্যালোচনার জন্য বুধবার (গতকাল) বৈঠক হবে বলে জানিয়েছিলেন। ওই দিন মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা কি আমাদের দেশের বাস্তবতায় জোর করে গাড়ি নামাতে পারব? আর গাড়ির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা খুব সামান্য মানুষ না, তারা অনেকেই খুব প্রভাবশালী।’
ঢাকাসহ সারা দেশের মালিক সমিতির নেতৃত্বে রয়েছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান ও ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের নেতা খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। দেশের পরিবহনশ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
বিআরটিএর বৈঠক
গতকাল বিআরটিএ কার্যালয়ের বৈঠকে মালিক-শ্রমিক ও বিআরটিএ কর্মকর্তাদের বাইরে শুধু দুজন ছিলেন। তাঁরা হলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ও সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, ইলিয়াস কাঞ্চন তাঁর বক্তব্যে নির্ধারিত ভাড়ার হার কার্যকর এবং যেসব মালিক বাস বন্ধ রেখে দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, অতীতে সরকার অনেক উদ্যোগ নিয়ে মাঝপথে আটকে গেছে। পরে আর সেই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। তাই এবার পিছু হটা উচিত হবে না।
সিটিং সার্ভিস বন্ধের অভিযান ১৫ দিন স্থগিত রাখা এবং এটি আইনি কাঠামোতে এনে চালু করার পরামর্শটি সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খানের কাছ থেকে এসেছে বলে বৈঠক সূত্র জানায়।
একপর্যায়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান বৈঠক থেকে উঠে নিজ কক্ষে ঘুরে আসেন। এরপরই সাংবাদিকদের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়। এ সময় তিনি বলেন, ‘একটা উদ্দেশ্য নিয়েই মালিকেরা সিটিং সার্ভিস বন্ধ করেছিলেন। তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাঁদের সে উদ্যোগে সহায়তা করেছি। তবে সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ার পর নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী যাত্রীদের অসুবিধার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে। এ জন্যই সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত ১৫ দিন স্থগিত করা হয়েছে।’
বিআরটিএর চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘সরকারি হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি যা ভাড়া আছে, তা নিতে হবে। সিটিং সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় সেসব কোম্পানি বাস বন্ধ রেখেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা তাদের তালিকা তৈরি করেছি। এখনো কাজ চলছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ দাবি করেন, ‘সব পরিবহনের বাস বন্ধ ছিল না। অ্যাঙ্গেল ও বাম্পার খোলার জন্য বাস গ্যারেজে রাখায় সড়কে গাড়ি কম ছিল। আমার জানামতে, একটি পরিবহন তাদের বাস বন্ধ রেখেছিল। অন্যরা নামিয়েছে। গত তিন দিন ২০ শতাংশ গাড়ি সড়কে অনুপস্থিত ছিল। তবে পরিস্থিতি আস্তে আস্তে উন্নতি হচ্ছিল।’
সিটিং সার্ভিস ১৫ দিন অব্যাহত রাখার বিষয়ে এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘আপনারা হয়তো বলতে পারেন, আমরা যুক্তি করে এটা করেছি, কিন্তু তা না। এখানে মালিকদের কেউ কথা বলেনি। এটা মালিকদের সিদ্ধান্ত না। সবার কথা শুনে বিআরটিএ চেয়ারম্যান এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’
বৈঠকে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না।
গতকাল যাত্রী কল্যাণ সমিতি এক বিবৃতিতে বলেছে, অবৈধ সিটিং সার্ভিস বন্ধ-চালুর খেলায় সরকারের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে গণপরিবহনে ‘ভাড়া ডাকাতি’ অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্র চলছে।
সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী অভিযোগ করেন, মালিক-শ্রমিক ও সরকার মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে যাত্রী দুর্ভোগ, ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি দিন দিন বাড়ছে। এসব পুঁজি করে মালিকেরা লাভবান হচ্ছেন।