সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী দুর্গম চাটিবহর কোনাগাঁওয়ের বাসিন্দা হনুফা বেগমসহ ৩২টি পরিবার গত শুক্রবার বন্যার পানিতে আটকা পড়ে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেলে বড় বড় কয়েকটি বালুবাহী স্টিলের নৌকায় আশ্রয় নেয় তারা। একসময় পরিবারগুলোর খাবারের মজুত শেষ হয়ে যায়। তিন দিন ধরে অভুক্ত থাকার কথা জানিয়ে হনুফা বেগম কল করেন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ। তাঁর ফোনের পর সিলেট জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. লুৎফর রহমান আটকে পড়া ৩২টি পরিবারের জন্য খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে উদ্ধার ও ত্রাণ চেয়ে এমন শত শত কল আসছে এখন ৯৯৯–এ। গত ১৬ জুন থেকে আজ বুধবার বেলা আড়াইটা পর্যন্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাহায্য চেয়ে কল এসেছে ৭৭০টি। এর মধ্যে সিলেট বিভাগ থেকেই সাহায্য চেয়ে কল এসেছে ৭৩৯টি। ৯৯৯ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ থেকে এ তথ্য জানা গেছে। শুরুতে পানিবন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধার চেয়ে কল বেশি এলেও গত সোমবার থেকে খাবার ও পানি চেয়ে কল বেশি আসছে। গত সোমবার দুপুর পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টায় শুধু খাবার চেয়ে ৩২টি কল এসেছিল। তবে বন্যাদুর্গত এলাকার বাইরে থেকেও ওই সব এলাকার জন্য সাহায্য চেয়ে কল আসার ঘটনা ঘটছে।
রাজধানী ঢাকার এক বাসিন্দা সিলেটে তাঁর আত্মীয়ের জন্য সাহায্য চেয়ে কল করেছিলেন। ওই ব্যক্তি জানান, তাঁর আত্মীয়রা বন্যার পানিতে আটকে আছে, খাবারের সংকট শুরু হয়েছে। এখন আত্মীয়দের মুঠোফোনে চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি আর যোগাযোগ করতে পারছেন না। তিনি আত্মীয়দের ঠিকানা দিয়ে খাবার পাঠানোর জন্য ৯৯৯–এ কল করে সাহায্য চান।
৯৯৯–এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে আসা সাত দিনের ৭৭০টি কল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিলেট বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলা এবং সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে সাত দিনে মোট ৭৩৯টি কল এসেছে সাহায্য চেয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কল এসেছে সুনামগঞ্জ থেকে। সেখানকার ১১টি থানা–পুলিশ এলাকা থেকে মোট ৩৭৪টি কল এসেছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ থানা–পুলিশ এলাকা থেকেই এসেছে ১১৬টি কল। এরপর সিলেট জেলার ১১টি থানা–পুলিশ এলাকা থেকে ২৩২টি এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের ৬টি থানা–পুলিশ এলাকা থেকে ১১৮টি কল এসেছে। মৌলভীবাজার থেকে ১১টি এবং হবিগঞ্জ থেকে ৪টি কল এসেছে ৯৯৯–এ। সিটি করপোরেশন এলাকাসহ চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণ এবং পাহাড়ধসের ঘটনায় সাহায্য চেয়ে কল এসেছে ৫টি। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, বগুড়া, বরিশাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ঢাকা ও কুমিল্লা থেকে ২৬টি কল এসেছে।
ভারী বর্ষণ, পাহাড়ধস ও বন্যাদুর্গত এলাকার বাইরের কলগুলো এসেছে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে। উদ্ধার ও খাবার চাওয়ার পাশাপাশি সিলেট থেকে দুটি কল এসেছিল ডাকাত এসেছে জানিয়ে। ৯৯৯ সেই দুটি কল নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারে, সিটি করপোরেশনের ত্রাণের নৌকাকে ডাকাত ভেবে ভুল করে কল করা হয়।
৯৯৯–এর ফোকাল পারসন (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকা থেকেই ফোন বেশি আসছে। শুরুতে পানিবন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধার চেয়ে লোকজন বেশি কল করেছেন। তিন দিন ধরে ত্রাণ চেয়ে কল বেশি আসছে। যাঁরা সাহায্য চাইছেন, তাঁদের ঠিকানা দিয়ে স্থানীয় থানা–পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছে ৯৯৯।
কল করলেই খাবার পৌঁছাচ্ছে কি না, জানতে চাইলে আনোয়ার সাত্তার বলেন, ‘এ মুহূর্তে প্রতিটি কল পরবর্তী ফলোআপ করা যাচ্ছে না। তাই কল করলে শতভাগ সাহায্য পাচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে আপনাদের নিউজেই তো দেখলাম ৯৯৯–এ কল করে লোকজন সাহায্য পাচ্ছে।’
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি এড়াতে সমন্বিত কার্যকর পরিকল্পনা নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবল স্টাডিজের পরিচালক সহকারী অধ্যাপক দিলারা জাহিদ।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার একটি অংশ হচ্ছে যোগাযোগ। তাই মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়ার জন্য ৯৯৯ বা অন্য যেকোনো হটলাইন নম্বরের গুরুত্ব রয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রচারেরও দরকার আছে। কোভিডের সময় সরকার ঘোষণাই দিয়েছিল এ ধরনের কলে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে। তাতে কাজও হয়েছিল। এবারও তেমন ঘোষণা আসা দরকার যেন মানুষ সাহায্য পেতে কল করার জন্য আস্থা পান। গণমাধ্যমেও এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন আসা দরকার।
দিলারা জাহিদ আরও বলেন, বন্যার পানি আজ না হয় কাল নেমে যাবে। তবে বন্যাকে কেন্দ্র করে ওই সব এলাকার মানুষ ঘর হারিয়ে, খাবার হারিয়ে যে নিঃস্ব হয়ে গেছে, সেটা মোকাবিলায় এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। এর জন্য বড় বাজেটেরও প্রয়োজন হবে না। কার্যকর পরিকল্পনা করলে অল্প বাজেটেই ভালো ফল পাওয়া যাবে।