এক
গত ফেব্রুয়ারিতে ঠিক এক দিনের ব্যবধানে চলে গেলেন আমাদের দুই প্রিয়জন। একজন হলেন খ্যাতিমান ব্যাংকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ (৪ জুলাই ১৯৪১—২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। তিনি ব্যাংক বা অর্থনীতি নিয়ে লিখতেন, সাহসী উচ্চারণ করতেন। আরেকজন হলেন লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ (২৩ অক্টোবর ১৯৪৬—২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১)। তাঁরা ছিলেন বাংলাদেশের আকাশে উজ্জ্বল দুই তারকা।
ব্যক্তিগতভাবে আমার কত কত স্মৃতি যে জমে আছে তাঁদের নিয়ে! কত ঋণে যে জড়িয়ে রেখেছিলেন আমাদের এই দুজন! তাঁদের নিয়ে লিখব লিখব করেও অতিমারি করোনার কারণে এত দিন ধরে লিখে উঠতে পারিনি। এ সময় আমি করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছি দুবার।
আমরা তখন ওয়ারীর লারমিনি স্ট্রিটের ১৫ নম্বর বাসায় থাকতাম। দীর্ঘ সময় থেকেছি সেখানে। সে সময় প্রায়ই দেখতে পেতাম, ঠিক সকাল নয়টার মধ্যে লারমিনি স্ট্রিটের ১৬ নম্বর বাসার সামনে সাদা হাফ হাওয়াই শার্ট, সাদা প্যান্ট, চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরা, হাতে কালো একটা ব্রিফকেস নিয়ে গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন এক রাশভারী ব্যক্তি। পরে জানতে পারি, তিনি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তবে তেমন কোনো যোগাযোগ-পরিচয় তখনো গড়ে ওঠেনি তাঁর সঙ্গে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ অগ্রণী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বে থাকার পর কৃষি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পূবালী ব্যাংকে যোগ দেন।
আমাদের বাসার পেছনের ছোট বারান্দা থেকে তাঁর বাসাটা দেখা যেত পরিষ্কার। দুই বাসার মাঝখানে একটা ছোট দেয়াল। মনে পড়ে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমাদের বাড়িতে দুবার পুলিশ এসেছিল—গভীর রাতে। তখন আমি সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। তো বাইরে থেকে আওয়াজ শুনে দুবারই আমি ছোট্ট দেয়াল টপকে গিয়ে খালেদ ভাইদের শোবার ঘরের পাশের দেয়াল ঘেঁষে দু-তিন ঘণ্টা বসে থেকেছি। তারপর পুলিশ চলে গেলে আমি আবার দেয়াল টপকে চলে এসেছি বাসায়। এ অভিজ্ঞতার কথা খালেদ ভাইকে বলার পর তিনি খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘তাহলে আমার দেয়াল বা উঠানও আপনার কাজে লেগেছে।’
সেই আশির দশকের মাঝামাঝি কার কাছ থেকে কীভাবে জানি না একটি কাগজ বা রিপোর্ট পেয়েছিলাম, যেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের এককালীন ডেপুটি গভর্নর এ কে গঙ্গোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন। রিপোর্টটি এমন ছিল যে ৯টি ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানির মালিকেরা ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ফেলেছেন। এখনো এটা শুনলে অবাক লাগে। এখন তো শত-হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা। এতে কারও গায়ে আঁচড়টুকু পর্যন্ত লাগে না।
যত দূর মনে পড়ে, ওই রিপোর্টটি নিয়ে আমি মতিঝিলে খালেদ ভাইয়ের অগ্রণী ব্যাংকের অফিসে যাই। একতা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিজের পরিচয় দিই। তখন তিনি বললেন, ‘আপনাকে আমি চিনি। আপনি তো আমাদের পাশের বাড়িতে থাকেন।’ আমি তাঁকে এ কে গঙ্গোপাধ্যায়ের কাগজ দেখালাম। তাৎক্ষণিক খালেদ ভাই আমাকে সাহায্য করতে শুরু করেন।
মি. গঙ্গোপাধ্যায়ের ৯ ধনিকের কথা শুধু নয়, সে সময় দেশে ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানিসহ ব্যক্তি-গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির কত রিপোর্ট আমরা ছেপেছি! এসব রিপোর্টের পেছনে বড় সহযোগিতা ছিল আমাদের খালেদ ভাইয়ের। ৪০ বছর পর এখনো সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে দেখা হলে তাঁরা সাপ্তাহিক একতার ওই রিপোর্টগুলোর কথা বলেন। অনেক প্রশংসা করেন। সিরিজটির নাম ছিল ‘ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটের কাহিনী’। মোট ৩৬টি রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল এই সিরিজে। ১৯৮৪ সালের ১৩ এপ্রিল শুরু হয়ে সিরিজটি শেষ হয় একই বছরের ১৬ নভেম্বর। অর্থাৎ প্রায় এক বছর ধরে মতিউর রহমান ও সৈয়দ আজিজুল হকের নামে রিপোর্টগুলো ছাপা হয়েছিল। তথ্য ও সংবাদ সংগ্রহের প্রধান দায়িত্ব ছিল আমার। পরে আমরা দুজন মিলে রিপোর্টগুলো তৈরি করতাম। লেখক হিসেবে পরিশ্রম বেশি করেছিলেন বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান সৈয়দ আজিজুল হক। দারুণ আলোড়ন তৈরি করেছিল সিরিজটি। পরবর্তীকালে সিরিজগুলো নিয়ে ‘ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটের কাহিনী’ শিরোনামে ১৯৮৭ সালের এপ্রিলে বই প্রকাশিত হয়। দুটি সংস্করণ বের হয়েছিল বইটির।
‘ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটের কাহিনী’র ওই রিপোর্টগুলো পড়লে আজ আমরা বিস্মিত হই।
কারণ, সেই সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান—সে সরকারি ব্যাংকই হোক আর বেসরকারি ব্যাংকই হোক, অর্থ লুট, দুর্নীতি, বিপুল খেলাপি এবং চরম অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা আজও আরও শত গুণ বৃদ্ধি পেয়ে একই রকমভাবে অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোতে তেমন উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বরং খারাপ হয়েছে। বেসরকারি কিছু কিছু ব্যাংক হয়তো ভালো করেছে। কিন্তু অনেক ব্যাংকই খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। এখন তো ব্যাংকের ভেতরে হানাহানি ও গোলাগুলির খবরও পাওয়া যায়। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে চুরি আর দুর্নীতির মহোৎসব চলছে আজও।
আমাদের ওই সব রিপোর্ট ছিল এরশাদের শাসনামলে। তখন তাঁর সহায়তায় দেশে বেসরকারি শিল্প খাত গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তাঁর সহযোগিতায়ই এই সুবিধাভোগীরা লুটপাট চালিয়েছিল। বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে ৩৭ বছর কেটে গেছে, এর মধ্যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, আবার বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু সাপ্তাহিক একতায় প্রকাশিত ওই সিরিজটিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতে দুর্নীতি-অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও নানা রকম গভীর সংকটের যে চিত্র আমরা প্রকাশ করেছিলাম, আজ সেটি শত থেকে হাজার গুণ বেড়েছে। হয়তো আরও বেশি, কে জানে! ব্যাংকগুলোর ঋণ খেলাপি, বিদেশে অর্থ ও সম্পদ পাচার—এসব তো বেড়েই চলেছে। মন্ত্রীরাই এখন এসব কথা বলেন। গত ১৯ এপ্রিল পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, বড় ব্যবসায়ীরা বিদেশে চলে যান। টাকাও চলে যায়।
অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতে বেশ কিছু ভালোর সঙ্গে সেই একই দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারি চলছে ব্যাপকভাবে—অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সরাসরি সহায়তায়। দেখা যায়, তখন যাঁরা এসব কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরা এখনো আছেন। রিপোর্টগুলোতে তখন সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক প্রভৃতির কেলেঙ্কারি ও অভ্যন্তরীণ সংকটের কথা বলা হয়েছিল। সেসব সংকট আজ আরও প্রকট হয়েছে। সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকে তো শুরু থেকেই শুরু হয়ে যায় খাওয়াখাওয়ি! এখন দু-তিনটি করে নতুন ব্যাংক আসছে।
১৯৮৪ সালে সাপ্তাহিক একতায় প্রকাশিত সেই সিরিজ রিপোর্টগুলো যাঁর কারণে আমরা করতে পেরেছিলাম, তিনি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। খালেদ ভাই তখন অগ্রণী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার। আসলে এতগুলো রিপোর্টের কৃতিত্ব আমাদের চেয়েও বেশি ছিল তাঁর। কারণ, আমরা কিছু তথ্য জেনেশুনে তাঁর কাছে যেতাম।
সেগুলোকে নিশ্চিত করা, যুক্তিগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার কাজ করতেন খালেদ ভাই। এক বছর ধরে আমরা এসব করেছি। একরকম নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল কাজটি। তারপর থেকে খালেদ ভাইকে আজীবন আমরা ব্যাংক আর অর্থনীতির অপরাধের বিরুদ্ধে এক যোদ্ধা হিসেবে দেখতে পাই।
নব্বইয়ের দশকে লারমিনি স্ট্রিটের ওই বাড়ি ছেড়ে খালেদ ভাই ওঠেন ১৫ লারমিনি স্ট্রিটের উল্টো দিকের একটা ফ্ল্যাটে। সেখানেও আমাদের বেশ যাওয়া-আসা ছিল। তারপর তিনি চলে যান ধানমন্ডিতে।
অগ্রণী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বের পর কৃষি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন খালেদ ভাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পূবালী ব্যাংকে যোগ দেন। তাদের একজন ভালো ও সৎ ব্যাংকারের প্রয়োজন ছিল।
২০০০ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে দুর্বল পূবালী ব্যাংককে তিনি একটি ভালো অবস্থানে নিয়ে যান। এটি এখন একটি সর্বস্বীকৃত সর্ববৃহৎ ভালো ব্যাংক। প্রথম বাঙালি ব্যাংক, যা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান আমলে।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নতুন গণতন্ত্রের আশায় আমরা দৈনিক ভোরের কাগজ করলাম, তারপর প্রথম আলো। ব্যাংক লুটপাট আর আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যত এক যুদ্ধ ঘোষণা করে পথে নেমে পড়লাম। খালেদ ভাই আমাদের সব সময়ের সাথি। কিন্তু আমরা কিছু করতে পারলাম না।
২০১০ সালে ইব্রাহিম খালেদকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত দায়িত্ব দিলেন শেয়ার কেলেঙ্কারি ঘটনার অনুসন্ধান করার। খালেদ ভাই দায়িত্ব নিলেন। অনুসন্ধানের পর দায়ী ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করলেন। ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাবও দিলেন। সরকার সেটা গ্রহণ করল না। বরং উল্টোটিই ঘটল। সরকারি মহল, সাংসদ ও মন্ত্রী অথবা যারা এই শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত, তাদের কাছ থেকে তিনি দিনের পর দিন হুমকি পেয়েছেন। নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন। তিনি কিন্তু নির্বিকার। নিজের সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। সরকারও নীরব।
প্রথম আলোতে আমরা যখনই খালেদ ভাইয়ের লেখা বা মন্তব্য চেয়েছি, তিনি লিখেছেন, শক্ত ও কড়া মন্তব্য করেছেন এবং অবশ্যই সঠিক মন্তব্য দিয়েছেন। নানা সময় প্রয়োজনীয় নানা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রথম আলোকে।
বেশ কিছু বইও আমরা পেয়েছি খালেদ ভাইয়ের কাছ থেকে। তাঁর লেখা ব্যাংকিং সংস্কার ও ব্যবস্থাপনা, মুক্তিসংগ্রাম ও মহানায়ক, জীবন যখন যেমন, ফিরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে, কিছু স্মৃতি কিছু কথা ইত্যাদি বই খুবই গুরুত্ববহ।
সেই ১৯৮৪ সালে যে অবস্থানে আমরা খালেদ ভাইকে দেখেছিলাম, পরবর্তী দশকগুলোতেও তাঁর সে অবস্থান একটু পাল্টায়নি। বরং ‘ধনিক গোষ্ঠীর লুটপাটের কাহিনী’কারদের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ ও ঘৃণা যেন দিন দিন আরও বেড়েছে। বলতে গেলে এ বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন সংশপ্তক, অর্থাৎ যিনি আমরণ যুদ্ধ করেন।
জীবনে কোনো অন্যায়-অপরাধ বা দুর্নীতি করেননি খালেদ ভাই; কারও দুর্নীতি, অন্যায় মেনেও নেননি। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে এসব করবেন না বা মানবেন না। সেই চেতনা থেকেই তিনি আমাদের সহযোগিতা করেছেন। একবার তাঁর কাছে গিয়েছিলাম আমার একজন অতি প্রিয় মানুষের ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়কে নিয়ে, ছোট একটি তদবির করতে। খালেদ ভাই কাজটি করেননি। ওই ব্যক্তিকে তিনি বলেছিলেন, ঠিক হয়ে তারপর আসুন। খুব লজ্জিত হয়েছিলাম।
এই যে দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে খালেদ ভাইয়ের একটি আপসহীন অবস্থান, এটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে এ রকম অবস্থান রেখে সম্মানের সঙ্গে টিকে থাকা, এটা আজকের বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য।
কঠিনভাবে ধর্মবিশ্বাসী খালেদ ভাই ছিলেন জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ। তিনি বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং শক্ত সমর্থক ছিলেন। তাঁদের বাড়ি ছিল গোপালগঞ্জে। ছোটবেলা থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। তাঁর কথা ছিল, আওয়ামী লীগে তো অনেক ভালো ব্যক্তি-মানুষ আছেন। সেই মানুষগুলোকে সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হোক। তাঁরা তো ভালো করতে পারবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও খালেদ ভাই তাদের ভুল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সত্য বলতে কখনো পিছপা হননি। যা বলার তা স্পষ্ট করে বলেছেন। সে জন্যই মনে হয় সরকার তাঁর ওপর খুশি ছিল না।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ শিশু-কিশোর প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার পরিচালক ছিলেন। এই সংগঠনের কাজে তিনি অনেক সময় দিয়েছেন। তিনি গুরুত্ব দিতেন শিশু-কিশোরদের সংগঠিত করাকে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শক্তিশালী হয়। আসলে বৃহদর্থে সব সময় তিনি দেশেরই মঙ্গল চেয়েছেন। নব্বইয়ের দশকের দিকে তিনি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসার ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন না। কাজকেই ভালোবাসতেন সব সময়।
এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি খালেদ ভাই চলে গেলেন সোহেলী বেগম এবং দুই সন্তান খোন্দকার জিনাত আফসানা হক, খোন্দকার সাঈদ হামিদসহ সবাইকে ছেড়ে। তাঁর মৃত্যু আমাদের জন্য একটি বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করল। দেশের অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি, ঋণখেলাপি ও ব্যাংক খাতে বড় বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সততা ও সাহসের সঙ্গে যে শক্ত অবস্থান এই সত্যবাদী ও স্পষ্টভাষী মানুষটি নিয়েছিলেন, তাতে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে তিনি আমাদের সময়ের একজন সেরা মানুষ ছিলেন। খালেদ ভাইয়ের মতো একনিষ্ঠ, সৎ ও সাহসী মানুষ বাংলাদেশে এখন বিরল।
সৈয়দ আবুল মকসুদের সঙ্গে আমার পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতা প্রথম আলোর শুরু থেকেই। তবে তাঁকে চিনতাম বহুদিন ধরে। তিনি আমাদের জন্য নিয়মিত কলাম লিখতেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ একজন নিয়মিত কলাম লেখক ও সাংবাদিক, একই সঙ্গে তিনি আবার উঁচু মাপের গবেষক। গবেষণার জন্য তিনি সব সময় মৌলিক সূত্রের ওপর নির্ভর করতেন। তাঁর তথ্যবহুল বইগুলোতে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এই পরিশ্রম ও মৌলিক সূত্রনির্ভরতার কারণেই এসব বইয়ের গ্রহণযোগ্যতাও অনেক বেশি।
হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলাকে ‘ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ’ হিসেবে অভিহিত করে ২০০৪ সালের মার্চে প্রথম আলোতে লিখলেন। তখন বাসস থেকে তাঁকে এ ধরনের লেখা আর লিখতে বারণ করা হলো। এর প্রতিবাদে তিনি বাসস থেকে পদত্যাগ করলেন। সেদিন থেকে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ল। আমাদের পারস্পরিক নির্ভরতাও আরও বেড়ে গেল। পরস্পরের আরও কাছাকাছি এলাম আমরা। সৈয়দ আবুল মকসুদ আমার দেখা একজন উঁচু মাপের মানুষ—সরল, সাধারণ ও নিরীহ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম আলোতে শুরুতে সপ্তাহে নিয়মিত দুটি কলাম লিখতেন—‘সহজিয়া কড়চা’ ও ‘বাঘা তেঁতুল’। কিছুদিন ধরে ‘বাঘা তেঁতুল’ লিখতে একটু অনিয়মিত হয়ে পড়লেও ‘সহজিয়া কড়চা’ লেখা চালিয়ে গেছেন নিয়মিতভাবে। কবিতা দিয়ে জীবন শুরু করা মানুষটি গবেষণার ক্ষেত্রে ছিলেন একনিষ্ঠ সাধকের মতো। পাশাপাশি সাংবাদিকতা ও গবেষণাসংক্রান্ত বই প্রকাশেও নিষ্ঠার অভাব রাখেননি। ২১ বছর ধরে প্রথম আলোতে কলাম লেখার সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশনের সঙ্গে বেশ জড়িয়ে পড়েন। প্রথমা প্রকাশনের ১১ বছরের জীবনে আমরা সৈয়দ আবুল মকসুদের ১০টি বই প্রকাশ করেছি। ‘নবাব সলিমুল্লাহ ও তাঁর সময়’, ‘পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’, ‘স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’, ‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু’, ‘কাগমারী সম্মেলন’সহ প্রতিটি কাজই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদের সম্পূর্ণ বইয়ের তালিকা দেখলে দেখা যায় যে কত বিচিত্র বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল। তাঁর আগ্রহের মধ্যে যেমন অনেক খ্যাতিমান মানুষ ছিলেন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও তাঁর সবিশেষ আগ্রহ ছিল। ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’, ‘স্যার ফিলিপ হার্টগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য’ ইত্যাদি বই এর প্রমাণ। এর মধ্যে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ বইটির জন্য ২০১৭ সালে তিনি প্রথম আলো বর্ষসেরা বই সম্মাননা অর্জন করেছিলেন। তাঁকে সম্মানিত করতে পেরে আমরা খুশি হয়েছিলাম খুব। এর আগে ১৯৯৫ সালে তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।
আমরা জানি, ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের পর এক অভিনব উপায়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন মকসুদ ভাই। তাঁর শপথ ছিল, যত দিন ইরাকে এই আগ্রাসন থাকবে, তত দিন পশ্চিমাদের উদ্ভাবিত সেলাইসহ কাপড় পরবেন না। সেটা রক্ষাও করেছিলেন আমৃত্যু। গরম বা শীতে সব সময়ই তাঁর পরনে শোভা পেয়েছে সেলাইবিহীন দুই টুকরা কাপড়। সঙ্গে একটি দেশি গেঞ্জি।
সৈয়দ আবুল মকসুদের দুই দশকের এই প্রতিবাদের মধ্যেও তাঁর চিন্তাচেতনায় চিরজীবন আমরা গান্ধীবাদের একটা প্রভাব দেখতে পাই। গান্ধীর অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। জীবনযাপনে গান্ধীর প্রতি তাঁকে বেশ আকৃষ্ট থাকতে দেখেছি আমরা। গান্ধীকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘গান্ধী নেহরু ও নোয়াখালী’ এবং ‘গান্ধী মিশন ডায়েরি’র কথা জানি আমরা। একটি ইংরেজি বইও লিখেছেন তিনি গান্ধীকে নিয়ে—‘Pyarelal’s unpublished correpondence The Noakhali Peace Mission of Mahatma Gandhi’। অন্যদিকে তিনি আবার মাওলানা ভাসানীর ভক্ত ছিলেন। আমরা ভাসানীর রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে অনেক তর্ক করতাম। তিনি নীরব থাকতেন।
এটা আমাদের জন্য খুবই উৎসাহজনক ছিল যে একজন নিয়মিত কলাম লেখক ও সাংবাদিক, একই সঙ্গে তিনি আবার উঁচু মাপের গবেষক। গবেষণার জন্য মকসুদ ভাই সব সময় মৌলিক সূত্রের ওপর নির্ভর করতেন। এ জন্য তিনি বাংলাদেশের জেলায় জেলায় ঘুরেছেন। পশ্চিম বাংলা, দিল্লি, প্যারিস, এমনকি পাকিস্তানে পর্যন্ত গেছেন। এই সূত্রে তিনি নানা মহৎ ব্যক্তির তথ্য, উপকরণ, পত্রিকা ও ডায়েরি সংগ্রহ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর তথ্যবহুল বইগুলোতে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এই পরিশ্রম ও মৌলিক সূত্রনির্ভরতার কারণেই এসব বইয়ের গ্রহণযোগ্যতাও অনেক বেশি।
প্রথম আলো কার্যালয় হয়ে গিয়েছিল মকসুদ ভাইয়ের অফিস। কলাম লেখার কাজ ছাড়াও তিনি প্রায় নিয়মিত অফিসে আসতেন বই লেখার কাজে। যাবতীয় তথ্য, কাগজপত্র ইত্যাদি নিয়ে সোজা প্রথম আলোর নতুন ভবনের ১৩ তলায় চলে যেতেন। সেখানে কম্পোজ বিভাগে সময় কাটাতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সম্পাদকীয় বিভাগের সদস্যদের সঙ্গেও রসাল আড্ডায় মেতে উঠতেন। মাঝেমধ্যে দেখা যেত প্রুফ বিভাগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে গল্প করছেন। এই চিত্র কিন্তু এক দিন বা সপ্তাহের নয়। মাসের পর মাস, বছরের পর বছরের চিত্র এটি।
প্রথম আলোর সবার সঙ্গে মকসুদ ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল আন্তরিক ও গভীর। তাঁর মতো আন্তরিক ও নিরহংকারী মানুষ আমরা খুব কমই দেখেছি। আবার কাজ শেষে কখনো কখনো আমরাও একসঙ্গে মিলিত হতাম, গল্প করতাম। দুপুরে ভাত আর বিকেলে একত্রে নাশতা খেয়েছি। বৃষ্টি বা প্রখর রোদ থাকলে নিম্নস্বরে বলতেন, বাড়ি যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা যায়? দ্রুতই গাড়ির ব্যবস্থা করেছি আমরা। দীর্ঘ আড্ডা দিয়েছি বহুদিন। ধীরে ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতেন মকসুদ ভাই। খুব রসিক মানুষ ছিলেন।
করোনাকালে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ কমে গিয়েছিল, কিন্তু ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে তাঁর শেষ বইটি আমরা তাঁকে দিতে পেরেছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘বইটা দেখে খুব ভালো লাগল। সুন্দর বাঁধাই ও মুদ্রণ। খুব যত্ন নিয়ে কাজ করেছেন। আমার আরও বই করতে হবে।’ আরও কিছু বইয়ের প্রস্তুতি ছিল তাঁর।
সৈয়দ আবুল মকসুদও খালেদ ভাইয়ের মতো সাধারণভাবে বর্তমান সরকারের সমর্থক ছিলেন। সরকারপক্ষের অনেকের সঙ্গে তাঁর ওঠা-বসা ছিল। সরকারের বিভিন্ন কাজে এর কিছু উপস্থিতি দেখতে পেয়েছি। তবে খালেদ ভাইয়ের মতো তিনিও সরকার দল, বিরোধী বা অন্য দলগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে যখন যেটা বলা উচিত, স্পষ্ট ভাষায় সেটা বলেছেন। সত্য বলতে তিনি মোটেই পিছপা হননি, কুণ্ঠাবোধ করেননি।
এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি স্ত্রী সুলতানা মকসুদ এবং দুই সন্তান জিহান মকসুদ ও সৈয়দ নাসিফ মকসুদসহ সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন মকসুদ ভাই।
এমন একজন মানুষের চলে যাওয়ায় আমাদের দেশের সাংবাদিকতা ও গবেষণার জগতে খুব বড় রকমের একটা শূন্যতা তৈরি হলো। প্রথম আলোর জন্য তো এই ক্ষতি তো অপূরণীয়। মৃত্যু মেনে নেওয়ার মতো বয়সে তিনি উপনীত হননি মোটেই। বয়সে তো আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট ছিলেন মকসুদ ভাই।
ব্যক্তিগতভাবে সৈয়দ আবুল মকসুদ আমার একজন ভালো বন্ধু ছিলেন। পরস্পরের অনুরাগী ছিলাম আমরা। বিপদাপদে সব সময় পরামর্শ দিয়েছেন, পাশে থেকেছেন। নানা বিষয়ে সতর্ক করেছেন আমাকে। বলেছেন, যেকোনোভাবে হোক, টিকে থাকতে হবে। ভালো ভালো কাজ করতে হবে। তাঁর মতো একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর এভাবে আকস্মিক চলে যাওয়াটা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের জন্য এটা দারুণ বেদনার। সৈয়দ আবুল মকসুদ ভাইয়ের প্রতি আমাদের গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অব্যাহত থাকবে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ও সৈয়দ আবুল মকসুদ—দুজনের কেউই রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি বা সম্মান পাননি। তাঁদের দুজনেরই বর্তমান সরকারের প্রতি সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, সহায়তার চেষ্টা করেছেন, পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করেছেন ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দেওয়ার। সেটা সরকারের খুব পছন্দ হয়নি। সে জন্যই বুঝি একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক পাওয়ার উপযুক্ততা বা যোগ্যতা খালেদ ভাই ও মকসুদ ভাইয়ের হয়নি। সেদিনও আমি একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকাটি দেখছিলাম। তথাকথিত অনেক ‘যোগ্যের’ তালিকাটি দেখে আমি খুবই বিস্মিত ও মর্মাহত হয়েছি। কত অজানা মানুষজনও পদকগুলো পেলেন, শুধু এই দুজনই কিছু পেলেন না। তাঁরা চানওনি। কোনো পদকের জন্য মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রীর বাসায় গিয়ে তদবির অথবা ফেসবুকে কিংবা অন্যভাবে চিঠি লিখে এসব চাওয়াচাওয়ি করা তাঁদের পছন্দের বিষয় ছিল না। এখনকার বাস্তবতা হলো, পুরস্কার পেতে হলে দলের প্রতি আনুগত্য থাকতে হবে। দলীয় লোকের প্রাধান্যই সর্বত্র। দলের বাইরে কিছু হবে না, চলবে না।
দেশের মানুষের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ও সৈয়দ আবুল মকসুদ কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন না। তাতে কী! স্বীকৃতি তাঁরা চেয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই। চাইলে নানা জায়গায় সরকারের সমালোচনামূলক লেখালেখি করতেন না। সত্যি বলতে, এসব স্বীকৃতির অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন তাঁরা দুজনই। এই দুই তারকা নিভে গিয়েছেন। কিন্তু নিজের আলোয় আলোকিত করে গেছেন আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মকে। আমরা তাঁদের কোনো দিন ভুলব না।