১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলা। একুশে ফেব্রুয়ারি পালন উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে শিক্ষকদের আলোচনা সভা চলছিল। কিন্তু পুরো কলা ভবন যেন একজনের কণ্ঠস্বরে কেঁপে উঠছিল। ৩৪ বছরের তরুণ এক শিক্ষক রক্তে ভেজা নিজের শার্ট দেখিয়ে সভায় ঝাঁজালো কণ্ঠে বলেন, ‘আহত ছাত্রদের পবিত্র রক্তের স্পর্শে আমি উজ্জীবিত। এরপর আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়, সেই গুলি কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে আমার বুকে বিঁধবে।’
সভায় বক্তব্য দেওয়ার ঘণ্টা কয়েক আগে ওই শিক্ষক বোয়ালিয়া থানায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আহত ছাত্রদের বন্দিদশা দেখতে পান। যন্ত্রণায় ছটফট করছিল তাঁর প্রিয় শিক্ষার্থীরা। কারও শরীর দিয়ে টপটপ করে ঝরছিল রক্ত। সেই ছাত্রদের প্রায় সবাই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার সমর্থনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবি আদায় ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে আগের দিন ১৬ ফেব্রুয়ারি হরতালে পুলিশে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ১৭ ফেব্রুয়ারিও সারা দেশের মতো রাজশাহী শহর বিক্ষোভে উত্তাল। জারি ছিল ১৪৪ ধারা। কিন্তু ছাত্ররা তা ভঙ্গ করায় আবারও চলে পুলিশের লাঠিপেটা ও প্রহার। আহত ১০ থেকে ১২ ছাত্র। নিজের ফক্সওয়াগন গাড়ি চালিয়ে থানায় সেই শিক্ষক।
থানায় রক্তাক্ত ছাত্রদের দেখে তিনি পুলিশকে বলেন, ‘আহত ছাত্রদের তো গ্রেপ্তার করে রেখেছেন। তাঁদের চিকিৎসা তো দিচ্ছেন না। এখন তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।’ এরপর এক এক করে নিজের হাতে করে ছাত্রদের পুলিশের ভ্যানে তুলে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। থানা থেকে ফেরার সময় ছাত্রদের জড়িয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা চিন্তা কোরো না। আমি ডাক্তারদের বলে দিয়েছি। তাঁরা তোমাদের দেখবেন। ইনশা আল্লাহ কাল সকালে আমি আবার আসব।’এক দিন পর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন ওই শিক্ষক।
তবে ছাত্রদের মতো করেই তাঁর বুক থেকে রক্ত ঝরছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে আহত। পানির তৃষ্ণায় ছটফট করতে করতে ওই দিন বেলা পৌনে দুইটায় মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন তিনি। এই শিক্ষক আর কেউ নন, তিনি হলেন ড. শামসুজ্জোহা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
কেন সেদিন প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন ড. জোহা? কী ছিল তার প্রেক্ষাপট। তাঁর ভাগনি খোন্দকার মমতাজ বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি (শামসুজ্জোহা) বেড়ে উঠেছেন আন্দোলন-সংগ্রাম দেখতে দেখতে। তাঁর জন্ম ১৯৩৪ সালের ১ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ গ্রামে। ভারত ভাগের সময় দাঙ্গায় তাঁদের ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। এরই মধ্য দিয়ে ১৯৫০ সালে বাঁকুড়ায় ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন শামসুজ্জোহা। পরে তাঁর বাবা-মা চলে আসেন পাবনার উল্লাপাড়ায় বড় পাঙ্গাসী গ্রামে। শামসুজ্জোহা ঢাকায় এসে দেখতে পান ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও তিনি অংশ নেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে উচ্চশিক্ষায় লন্ডনে চলে যান তিনি। উচ্চশিক্ষা শেষে যখন শামসুজ্জোহা দেশে ফিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন, তখনো পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে উত্তাল সারা দেশ।
এই আন্দোলন-সংগ্রাম দেখে বা অংশ নিতে নিতে নেতৃত্বের গুণ যেন ড. শামসুজ্জোহার মধ্যে গেঁথে যায়। অসম্ভব ছাত্রবান্ধব ছিলেন ড. জোহা। মমতাজ বেগমই জানিয়েছেন, শ্রেণিকক্ষের পাঠ শেষ হলেই ছাত্রদের বন্ধু হয়ে যেতেন তিনি। ক্যাম্পাসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতেন। প্রতি বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ফুটবল খেলা ছিল তাঁর নেশার মতো। ক্রিকেটটা খুব পছন্দ করতেন। ঘরে থাকলে রেডিও খুলে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী শোনা তাঁর অভ্যাস। ছাত্রজীবনে জেলা ক্রিকেট দলে খেলেছিলেন তিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। বেশ ভালো ব্যাটসম্যান ছিলেন। খুব বেশি বল না করলেও ভালো মিডিয়াম পেসার ছিলেন তিনি।
ড. শামসুজ্জোহা ছিলেন আপনভোলা প্রকৃতির। এ মন্তব্য করে খোন্দকার মমতাজ বেগম বলেন, ‘মামা যখন শিক্ষক, আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞানের ছাত্রী। মামার সঙ্গে ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি তিনি পাশে নেই। তাকিয়ে দেখি, কোনো এক গাছে থাকা একটি ফুল দেখছিলেন। আবার বই পড়ার সময় ঘোরের মধ্যে ডুবে যেতেন। রাত গড়িয়ে ভোর হলেও তাঁর খেয়াল থাকত না। ক্যাম্পাসে বাইরে আমাদের বাসায় এলে ছোটদের নিয়ে খেলতেন। ডাংগুলি খেলাটা যে কত মজার হতে পারে, তা আমরা মামার কাছ থেকে শিখেছি।’
১৯৬১ সালে ড. শামসুজ্জোহা বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম নীলুফার জোহা ডলি। জোহা-ডলি ক্যাম্পাসে রোমান্টিক দম্পতি হিসেবে পরিচিত ছিল। খোন্দকার মমতাজ বেগমের কাছে সেই স্মৃতিও উজ্জ্বল, ‘তাঁরা পুরো ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতেন। ১৯৬৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁদের একমাত্র মেয়ে সাবিনা জোহা ডালিয়ার জন্ম। ক্যাম্পাসে সে ছোট ছোট পায়ে হাঁটত। পেছনে মামা-মামি গল্প করতেন আর মেয়ের দিকে নজর রাখতেন। একজন বাবা কিংবা স্বামী হিসেবে দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করতেন শামসুজ্জোহা। বয়সে ছোট হলেও আমাদের পরিবারের অভিভাবকেরা যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাঁর মতামত নিতেন।’
ড. জোহা দুনিয়া ছেড়েছেন বীরের মতোই। তবে মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক ছাত্রের আচরণে কিছুটা কষ্ট পেয়েছিলেন। তখন নাকি সেই ছাত্রকে বলেছিলেন, ‘দেখো, তোমরা এমন করলে, কিন্তু কদিন পর কাঁদতে হবে।’ তিনি এ কথা বলেছিলেন কারণ, মাস কয়েক পর স্কলারশিপ নিয়ে তাঁর কানাডায় যাওয়ার কথা ছিল। মামা যদি কানাডায় চলে যেতেন, তাহলে আমাদের আর কাঁদতে হতো না।