নাম মিছিল আরিয (ছদ্মনাম)। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক। কর্মক্ষেত্রে জনপ্রিয়। ভালো ফলাফলের জন্য পাশ করার পরই তিনি চাকরি পেয়ে যান। বেকারত্ত্বের যন্ত্রণায় জ্বলতে হয়নি। কিন্তু কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের লিখিত পরীক্ষায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। তার বন্ধুরা এতোদিনে জুডিসিয়াল সার্ভিসে তিন ব্যাচ সিনিয়র হয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছাড়তে উদগ্রীব হওয়ার কারণ জানতে চাওয়ায় হাতাশা ভরা উত্তর দেন। তাঁর হবু স্ত্রী ও তাঁর পরিবার চায় বিচারকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ভান্ডারে যথেষ্ট সালাম মজুদ থাকলেও দেহরক্ষী, আর্দালি যে শুধুই বিচারক, প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীতে তা কন্যার পরিবার ভালো করেই ঠাওর করতে পেরেছেন। ফলে সন্তোষজনক চাকরি করার পরও উল্লেখিত ব্যক্তি বেকারের মতো অস্থির সময় পার করছেন এবং জুডিসিয়ারি পরীক্ষায় বসেছেন।
অনভিপ্রেতভাবে এবং পাগলপ্রায় হয়ে আমাদের সমাজ ও তারুণ্য ইদানীং চাকুরী বলতে কেবল ক্যাডার সার্ভিস বা সরকারি চাকুরিকেই বুঝে থাকে। যার ফলাফল অন্য পেশাজীবীদের মধ্যে হীনম্মন্যতা বৃদ্ধি, চাকুরি পাল্টানোর ঝোঁক যা প্রকৃতপক্ষে তাদের কর্মদক্ষতা হ্রাস করে ফেলছে। সমাজে চাকুরীজীবীদের মাঝে বিভাজন রেখা স্পষ্ট। এর মাঝে সরকারি চাকরি একদিকে। অন্যদিকে বেসরকারি চাকরির কথা তো আলোচনায়ই আসে না। অথচ দেশে সরকারি চাকুরিজীবীর সংখ্যা মাত্র ২১ লাখের মতো। দেশের অর্থনীতির কাঠামো ঠিক রাখা ও সেবা খাতের বড় অংশে বেসরকারি চাকুরীজীবীদের অংশগ্রহণ অভাবনীয় থাকা সত্ত্বেও তাদের অবদান সামাজিকভাবে খুব কমই স্বীকার করা হয়। ফলে অপেক্ষাকৃত বেশি মেধাবী লোকদের অনেকেই ঠেকা না হলে বেসরকারি খাতে আসতে চায় না স্রেফ সামাজিক স্বীকৃতির অভাবে।
২.
একটি বিসিএস পরীক্ষার সার্কুলার আসা থেকে চূড়ান্ত নিয়োগ হতে প্রায় ২–৩ বছর সময় লেগে যাচ্ছে। প্রতি বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে কমবেশি ২ হাজার জন নিয়োগ পায়। অথচ আবেদন জমা পড়ে ৩–৪ লাখের মতো (এর কমবেশিও হয়)। প্রিলিমিনারি, লিখিত, ভাইভা—এ তিন ধাপে প্রার্থী বাছাই শেষে চূড়ান্তভাবে মনোনীত হন চাকরীপ্রত্যাশীরা, যা অত্যাধিক প্রতিযোগিতাপূর্ণ। ফলে বেশিরভাগ প্রার্থী বাদ পড়ে যাদের মধ্যে অসংখ্য মেধাবী প্রার্থী থাকেন। তাই বলে কি বাদ পড়াদের ব্যর্থ বলা যায়? মেধাহীন বিবেচনা করা যায়? বাস্তবতা হলো এক সময়ের সহযোদ্ধারা কিঞ্চিৎ বেশি মেধার ফলে অথবা নিদেনপক্ষে ভাগ্যের সহায়তায় বড় পদে আসীন হন। আর বাকিরা ব্যর্থ সাব্যস্ত করে ঘৃণার আগুণে ঘি ঢালে আমাদের নির্বোধ সমাজব্যবস্থা। ফলত, তারুণ্য নিমজ্জিত হয় হতাশার অতল গহ্বরে।
৩.
আজমত হোসেন (ছদ্মনাম), এইচএসসি পর্যন্ত ইংরেজি সংস্করণে পড়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ শেষে দুইবার বিসিএস ভাইভা দিয়েছিলেন। কিন্তু চাকরি পাননি। বর্তমানে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রথম শ্রেণীর চাকরি করে দুর্নীতি দমনে ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় বন্ধুমহল, আত্মীয়-স্বজন বিসিএস না হওয়ার জন্য এখনো প্রায়ই আফসোস করেন।
মিতুর আজওয়া (ছদ্ম নাম) পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। নিজ ডিসিপ্লিনে কাজ করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু বিসিএসে আইসিটি ক্যাডার নেই বলে তিনি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণই করেননি। বর্তমানে তিনি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সহকারী প্রোগ্রামারের কাজ দারুণ উপভোগ করলেও বিসিএস পরীক্ষা না দেওয়ায় তাঁর আশপাশের সবাই হতাশ।
আনিছার মমিন (ছদ্ম) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। বন্ধুরা বেশিরভাগ জুডিসিয়ারিতে এলেও তিনি কখনো চাকরির আবেদনই করেননি। এ নিয়ে তিনি কখনো আফসোস করেন না।
অসীমাভ বসু (ছদ্মনাম) ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অসাধারণ ব্যক্তিত্ত্ব, নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, বিরল মেধা- মননের অধিকারী একজন তরুণ শিক্ষক। চমৎকার একাডেমিক রেজাল্ট ও শিক্ষকতা পেশার সুবাদে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের অমিত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এবং বর্তমানে প্রায় লাখ টাকা বেতনের চাকুরীও তাকে একালের অস্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন বিয়ের বাজারের জন্য প্রস্তুত করতে পারেনি। কনেপক্ষের ছোট্ট আবদার ছেলে যেন সরকারি চাকুরি করে। তিনি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে শিক্ষকতাকে মহান ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি তার মাথায় থাকলেও অব্যাহত বুলিংয়ের শিকার হয়ে তিনি আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছেন।
অথচ দেশে এখন এক শটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অভিমানে এসব শিক্ষকগণ পেশা পাল্টালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান আরও নাজুক হবে। অন্যদিকে, আন্তঃক্যাডার কোন্দল এখন খোলামেলা ব্যাপার। অপেক্ষাকৃত বেশি সুযোগ সুবিধার ক্যাডারে যাওয়ার জন্য বহু ক্যাডার অফিসারকে বারংবার বিসিএস পরীক্ষা দিতে দেখা যায়।
আমাদের বুঝতে হবে যে, উদ্যোক্তা হওয়া মানে চাকুরি না পাওয়া নয়। অনেকেই নিজ উদ্যোগে স্বাধীনভাবে কিছু করতে চায়। তার চেষ্টাকে সম্মান জানাতে হবে। মো. শেরশাহ, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সমুদ্রগামী জাহাজে কাজ শুরু করেন। তিনি এই কাজে অস্বস্তিবোধ করায়, পেশা পাল্টে একটি পোশাক কারখানা গড়ে তুলেছেন। সেখানে প্রায় ৫০ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ আত্মীয়-স্বজনেরা তাকে এখনো খোঁটা দেয় যে, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কেন সে কাপড়ের ব্যবসা করছে?
আমাদের বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা শিক্ষিত ও ভিন্নভাবে চিন্তাশীলদের প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকলে অন্যরা মানুষদের যে কীভাবে মূল্যায়ন করে তা সহজেই অনুমেয়।
৪.
তরুণদের যেকোনো বৈধ কাজে উৎসাহ দিতে হবে। তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে যে যেভাবেই, যে মানেরই কর্মসংস্থান করতে পেরেছে তাঁকে স্বস্থানে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। উৎসাহ, স্বীকৃতি পেলে তাঁর উৎপাদন ক্ষমতা, কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড যুগে প্রবেশ করেছে। জাতি হিসেবে এই সুবিধার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে দেশ পিছিয়ে যাবে। এখন মোট জনসংখ্যার বিরাট অংশ কর্মক্ষম। তাদের কাজ ও কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। নতুবা এই বৃহৎ শক্তি বিপথে গেলে মহামারি আকার নেবে যার ক্ষতি পূরণযোগ্য হবে না।
উদ্যোক্তাদের বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। যে তরুণ ব্যবসা করতে চায় তাকে সাহস জুগিয়ে সম্মান জানাতে হবে। তাহলেই আরো বেশি করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বেকারত্ব তো কমবেই। বরং কাজের জন্য লোক পাওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে তাকে বিপদগামী বিবেচনা করা চলবে না। আধুনিক ব্যবসায়- বাণিজ্যে যোগাযোগ দক্ষতা, বহুভাষা জ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তির জুতসই ব্যবহার জানতে হয়। কাজেই ব্যবসায় ক্ষেত্রে শিক্ষিত জনবল সম্পৃক্ত হওয়া মানেই ব্যবসার প্রবৃদ্ধি আরো বেশি করে নিশ্চিত হওয়া। তাই উদ্যোক্তাদের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলে চাকুরী খোঁজার উপর চাপ কমবে।
মাঠ প্রশাসন কাঠামো ঠেলে সাজাতে হবে। চাকুরির আভিজাত্য নির্ভর করে কর্মপরিধি ও অবদান রাখার সুযোগের প্রাপ্যতার উপর। দেশের প্রায় সকল সরকারি সেক্টর ক্যাডার সার্ভিস দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ননক্যাডারগণ নিজেদের পরাধীন মনে করেন। যদিও তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেসিক অফিসার হিসেবে কর্ম সম্পাদন করে থাকেন। তাই সুপেরিয়র সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ক্যাডার সার্ভিস কেন্দ্রীয় প্রশাসন পরিচালনা করবে। ননক্যাডারেরা স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্ত্ব দেবেন। এতে পদোন্নতি কাঠামো সহজীকরণ হবে। অফিসাররা খুশি মেজাজে আরও স্বাধীনচেতা হয়ে জনসেবা দিয়ে থাকবে।
বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে স্বাধীন মেধাভিত্তিক প্রসিকিউশন সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে আইনজীবীদের মধ্য হতে যারা সরকারি তকমা লাগাতে চায়, তারা যেন মেধার ভিত্তিতে দক্ষ বিচার ব্যবস্থার অংশ হতে পারে। বর্তমানে পাবলিক প্রসিকিউটর, গভর্নমেন্ট প্লিডার নিয়োগ হচ্ছে ঢালাওভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় যেদিকে মেধাবীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বা সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে।
পুনশ্চঃ বিভেদ ঘোচানোর চেষ্টাটা সবাইকে মিলেই করতে হবে। এ লক্ষ্যে, সমমনাদের আন্তঃপেশাজীবী সম্প্রীতি সমিতির আদলে আঞ্চলিক চর্চাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করায় মনোনিবেশ করতে হবে। এ সমাজ আর কবে বুঝবে যে, আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম কুড়াতে কিছু বিশ্বমানের খেলোয়াড় দরকার। বিনোদনের জন্য কিছু প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পী দরকার। আর হতাশায় ভোগা তারুণ্যের জন্য প্রেরণাদায়ী বক্তা দরকার। সময়কে অক্ষরের ফ্রেমে বাধতে কিছু লেখক চাই। করোনা ভাইরাসের মত মরণঘাতী রোগের এন্টিভাইরাস আবিষ্কার করতে একদল চিকিৎসাবিজ্ঞানী দরকার। মিয়ানমারের সাথে মামলা জিততে আমাদের পড়ুয়া আইনজীবী দরকার। শুধু পুলিশ, প্রশাসক, ম্যাজিস্ট্রেট লইয়া আমরা কী করিব?
*লেখক: আইন কর্মকর্তা, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। bellal.sincere@gmail.com