গ্যাস–সংকট

সামনে আরও ভোগান্তি

সেচ মৌসুমে গ্যাসের চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে পেট্রোবাংলা। এলপিজির দাম বাড়ছে লাফিয়ে।

ঢাকায় তিতাসের গ্রাহক ২৮ লাখ ৭৫ হাজার

এর মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ২৮ লাখ ৫৫ হাজার

সব মিলে দিনে তিতাসের চাহিদা ২০০ কোটি ঘনফুট

গতকাল পেয়েছে ১৭২ কোটি ঘনফুট

সেচ মৌসুম শুরু হচ্ছে আগামী সপ্তাহে। গ্যাসের বাড়তি চাহিদা দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। কিন্তু গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো উন্নতি নেই। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ালে কমবে অন্য খাতের সরবরাহ। এতে গৃহস্থালি রান্নায় গ্যাসের সরবরাহ কমতে পারে। তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দামও টানা বাড়ছে। সব মিলে রান্নার চুলা জ্বালাতে ভোগান্তি আর খরচ আরও বাড়বে।

জ্বালানি গ্যাসের চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৭০ কোটি ঘনফুট। স্বাভাবিক সময়ে ৩০০ থেকে ৩১০ কোটি ঘনফুটের মতো সরবরাহ করতে পারে পেট্রোবাংলা। গত ২৫ অক্টোবর থেকে দিনে সরবরাহ কমেছে ৩০ কোটি ঘনফুট। সর্বশেষ গতকাল সরবরাহ করেছে ২৭৬ কোটি ঘনফুট।

দিনে সর্বোচ্চ ৭০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে গত বছর। বর্তমানে এটি ৪০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। কাতার ও ওমানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আরও ৬ কোটি ঘনফুট সরবরাহ বাড়বে।
আরপিজিসিএলের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা

পিডিবির দুজন কর্মকর্তা জানান, গত সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ হাজার ৯৭৭ মেগাওয়াট। এবার ১৪ হাজার মেগাওয়াটের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ খাতে দিনে গ্যাসের সরবরাহ লাগবে ১৫৫ কোটি ঘনফুট। গতকাল সরবরাহ করা হয়েছে ৮০ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে না পারলে জ্বালানি তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেশি হারে উৎপাদনে রাখতে হবে। এতে পিডিবির ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে পেট্রোবাংলাকে নির্দেশনা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

গ্যাস সরবরাহে রেশনিং

পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি কমে যাওয়ায় গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কাতার ও ওমান থেকে নিয়মিত এলএনজি পাচ্ছে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। এর বাইরে খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে আমদানি করে তারা। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় নভেম্বর ও ডিসেম্বরে দুটি ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়েছে। দাম একটু কমায় এখন আবার কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে সরবরাহ না বাড়া পর্যন্ত রেশনিং (এক খাতে কম দিয়ে আরেক খাতে বাড়ানো) করেই চালাতে হবে।

আরপিজিসিএলের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দিনে সর্বোচ্চ ৭০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে গত বছর। বর্তমানে এটি ৪০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। কাতার ও ওমানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আরও ৬ কোটি ঘনফুট সরবরাহ বাড়বে। মার্চে প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতে পারে। খোলাবাজার থেকে দ্রুত গ্যাস কেনার জোর তৎপরতা চলছে। ইতিমধ্যেই দরপত্রের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এপ্রিল থেকে আবার ৭০ কোটি ঘনফুটে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে।

স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস সংগ্রহ করতে জোর চেষ্টা চলছে। শিগগিরই সরবরাহ বাড়বে। এর আগপর্যন্ত চাহিদা বুঝে রেশনিং করেই চালাতে হবে।
আলী মো. আল মামুন, পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস)

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) আলী মো. আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস সংগ্রহ করতে জোর চেষ্টা চলছে। শিগগিরই সরবরাহ বাড়বে। এর আগপর্যন্ত চাহিদা বুঝে রেশনিং করেই চালাতে হবে।

গৃহস্থালিতে কমতে পারে সরবরাহ

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা লাইজু বেগম বলেন, সকাল আটটার পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে গ্যাস। নয়টার পর আর চুলা জ্বলে না। দুপুরের পর থেকে আবার পাওয়া যায়। তিন মাস ধরেই এ সমস্যা। এখন এক দিন পেলেও আরেক দিন সমস্যায় থাকি।

দেশের ১১ শতাংশ মানুষ রান্নায় প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে, যার বড় অংশ রাজধানী ঢাকা শহরের। ঢাকায় গ্যাস সরবরাহকারী তিতাস গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, তিতাসের গ্রাহক ২৮ লাখ ৭৫ হাজার। এর মধ্যে আবাসিক গ্রাহক আছেন ২৮ লাখ ৫৫ হাজার। সব মিলে দিনে তিতাসের চাহিদা ২০০ কোটি ঘনফুট। সর্বশেষ গতকাল পেয়েছে ১৭২ কোটি ঘনফুট।

তিতাসের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, গ্যাসের ঘাটতি থাকায় সরবরাহে সমস্যা হয়েছে। তাপমাত্রা বাড়ায় সেচের পাশাপাশি অন্য খাতেও বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়বে। তাই বিদ্যুতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ালেই মার্চে গৃহস্থালিতে গ্যাসসংকট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।

এলপিজির দাম বাড়ছে লাফিয়ে

বর্তমানে দেশের ১৩ শতাংশ মানুষ রান্নায় এলপিজি ব্যবহার করছেন। ৩৮ লাখ গ্রাহক এলপিজি ব্যবহার করেন। তাঁরা পড়েছেন বাজারে বিদ্যমান অনিয়ন্ত্রিত দামের ফেরে। মানিকগঞ্জের আতিকুল ইসলাম বলেন, মাসে ৯৭৫ টাকা দিলেও লাইনে বেশির ভাগ সময় গ্যাস থাকে না। তাই এলপিজিও ব্যবহার করতে হয়। এখন সেটির দামও বাড়ছে হু হু করে।

১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার এখন কোম্পানি ভেদে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত মাসে এটি ছিল ৯৫০ থেকে ১ হাজার ৫০ টাকা। এর আগের মাসে আরও ১০০ টাকা কম ছিল। সরকারিভাবে এলপিজির দাম নির্ধারণ করতে গত ১৪ জানুয়ারি গণশুনানি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এরপর প্রায় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেনি বিইআরসি। তবে এলপিজি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়তে থাকায় দেশেও এর দাম বাড়ছে। জ্বালানির দামবিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান এসপিগ্লোবালের ওয়েবসাইট বলছে, কয়েক মাস ধরেই টানা বাড়ছে এলপিজির দুই উপাদান প্রপেন ও বিউটেনের দাম।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভোক্তার স্বার্থে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। যত দ্রুত এটা নেওয়া হবে, তত মঙ্গল। বিইআরসি শিগগিরই এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করে ভোক্তার স্বার্থ ও ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের দিকটি সংরক্ষণ করতে পারে।