তৈরি পোশাকশিল্প

সাফল্যের এক বিজয়কেতন

একটি তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকেরা কাজ করছেন। ছবি: প্রথম আলো
একটি তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকেরা কাজ করছেন। ছবি: প্রথম আলো

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অসাধারণ সাফল্যের শুরুটা ছিল সাদামাটাভাবে। একজন অবসরে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা আমলা নুরুল কাদের খান দেশ গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেন দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু করপোরেশনের সহায়তায় ১৯৭৮ সালে। তাঁর প্রতিষ্ঠানের ১৩০ জনকে দক্ষিণ কোরিয়া নিয়ে যান তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের জন্য। আশির দশকের শুরুতে আরও কয়েকটি পথিকৃৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বন্ড গার্মেন্টস, রিয়াজ গার্মেন্টস, সানম্যান গ্রুপ, স্টাইলক্রাফট ও অ্যারিস্টোক্রেট গার্মেন্টস। বাংলাদেশ থেকে যখন রেডিমেড গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাক রপ্তানি পথচলা শুরু করে তখনো বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিও প্রতিষ্ঠা হয়নি। তবে জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেডের (গ্যাট) আওতায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সক্রিয় দেশগুলো সে সময় বিশ্ববাণিজ্যকে একই ধরনের আইনের আওতায় এনে যত দূর সম্ভব শুল্ক ও অন্যান্য বাধা দূর করতে সচেষ্ট ছিল।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই বিশাল সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করে। শ পাঁচেক কারখানা ও লাখ দুয়েক শ্রমিক নিয়ে সবাইকে চমকে দেয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি। যার ফলে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি ১৯৮৬ সালে পোশাক রপ্তানির ব্যাপারে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে, যাতে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপের বাজারে কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ইইউর জিএসপি–সুবিধায় শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ ভোগ করে। তবে জিএসপির তখনকার দুরূহ আইনের কারণে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এ সুবিধা তেমন ব্যবহার করতে পারেনি। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অনেকটাই উদারভাবে তৈরি পোশাকের জন্য কোটা বরাদ্দ করেছিল। একদিকে ইউরোপের বাজারে কোটামুক্ত রপ্তানি ও অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বরাদ্দ বিশাল কোটা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রাণের জোয়ার সৃষ্টি করে। তবে ভুলে গেলে চলবে না রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় বন্ডেড ওয়্যারহাউস ও ব্যাক টু ব্যাক এলসির যে সুবিধা তৈরি পোশাকশিল্প শুরুতেই পেয়েছিল, তা ছিল সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি। ইউরোপে কোটামুক্ত ব্যবসার সে সময়ের সাফল্যের নমুনা হচ্ছে বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে ২০ লাখ টি–শার্ট রপ্তানি করেছিল। আর মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে সেটি পৌঁছেছিল প্রায় ১০ কোটিতে। প্রবৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার শতাংশ। সে সময় চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ইউরোপের বাজারে মোট টি-শার্ট রপ্তানির চেয়েও বেশি ছিল বাংলাদেশের রপ্তানি। অবশ্যই মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের সব কটি প্রতিযোগী দেশই তখন কোটার বেড়াজালে আটকা ছিল।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বস্ত্র ও পোশাক খাতে ধাপে ধাপে কোটা উঠে যেতে লাগল। এ ব্যবস্থাটি ছিল দ্য অ্যাগ্রিমেন্ট অব টেক্সটাইল ও ক্লথিংয়ের (এটিসি) আওতায়। বলা ছিল ২০০৫ সালের মাঝেই কোটা পুরোপুরিই উবে যাবে। এ নিয়ে বাংলাদেশে যথেষ্ট উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যেই তৈরি পোশাক রপ্তানি (নিট ও ওভেন) বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখতে শুরু করেছে। সোনালি আঁশ পাটকে বহু পেছনে ফেলে রপ্তানি আয়ের বিশাল অংশীদার হয়ে গেছে। তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যাও চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে। একই সঙ্গে ২০ লাখ শ্রমিকের ভবিষ্যৎ নিয়েও ছিল ভাবনা।
আশঙ্কা ছিল গ্রাম থেকে আসা নারী শ্রমিকেরা কি আবার অসহায় হয়ে ফিরে গিয়ে আগের মতো স্বামী বা বাবা-মায়ের সংসারে কোণঠাসা হয়ে থাকবেন? সে রকম কিছুই হয়নি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় চার দশকের যাত্রায় অনেক চড়াই-উতরাই ছিল। প্রথম চ্যালেঞ্জ আসে যখন ১৯৯৫ সালে, পোশাকশিল্পে শিশুশ্রম ব্যবহারের অভিযোগ তোলে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা সরকার ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় শিশুশ্রমের সমস্যার একটি বাস্তব ও মানবিক সমাধান করেন। এরপরই ইইউতে প্রায় ২৭ হাজার জিএসপি সার্টিফিকেট বাতিল করার দাবি আসে ১৯৯৭-৯৮ সালে। ইইউ দাবি করেছিল এগুলো জিএসপির আইন মেনে ইস্যু করা হয়নি। এটিও সাফল্যের সঙ্গে সুরাহা করা হয়। প্রশ্নবিদ্ধ জিএসপি সার্টিফিকেটগুলোর অধিকাংশই ছিল নিট পোশাক (টি-শার্ট) ও কিছু ছিল ওভেন পোশাক (যেমন শার্ট ও ট্রাউজার) রপ্তানিতে। ইইউ নিট পোশাকে দেশে প্রস্তুত সুতা বা ইয়ার্ন ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা তুলে নেয় জিএসপির রুল অব অরিজিন থেকে ১৯৯৯ সালে। নিট পোশাকের আইনে এ শিথিলতা বাংলাদেশের সোয়েটার ও টি-শার্ট রপ্তানিতে বিশাল সাফল্য এনে দেয়, বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে। কয়েক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে তৈরি টি-শার্ট ও সোয়েটার যথাক্রমে ইউরোপের বাজারে রপ্তানিতে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নেয়, যা এখনো অব্যাহত আছে।

সূত্র: ইইউ এক্সপোর্ট হেল্প ডেস্ক, অক্টোবর ২০১৭

বরাবরই তৈরি পোশাক থেকে আয়ের বেশি অংশটি আসত ওভেন পোশাকের রপ্তানি থেকে। একসময় নিট পোশাকের আয় পেছনে ফেলে ওভেন পোশাকের রপ্তানি আয়কে। ইইউ যখন ২০১১ সালে ওভেন পোশাক রপ্তানিতে স্বল্পোন্নত দেশের জন্য রুল অব অরিজিন শিথিল করে, এর কয় বছরের মধ্যেই নিট ও ওভেন পোশাক থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় আধাআধিতে চলে আসে।
বিশ্ববাণিজ্য মন্দায় পড়ে যায় ২০০৮ ও ২০০৯ সালে। তখন আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশের বিশাল তৈরি পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ তার সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখে, যদিও গতিটা মন্থর ছিল।
তৈরি পোশাক রপ্তানির বিজয়রথ বেশ বড় বাধার সামনে পড়ে যখন ২০১৩ সালে রানা প্লাজার ধসে হাজারো শ্রমিক প্রাণ হারান।
সারা বিশ্বের নজরে আসে বাংলাদেশের কারখানায় শ্রমিকের কর্মপরিবেশ। ক্রেতা দেশগুলোতে দাবি ওঠে বাংলাদেশের শ্রমিকের নিরাপত্তা ও অধিকারের উন্নতি না হলে আমদানি কমিয়ে আনার।
ক্রেতা, বিক্রেতা, সরকার, শ্রমিক অধিকার সংগঠনের সম্মিলিত প্রয়াস বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সচেষ্ট হয়। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন, ইউরোপ ও আমেরিকার আমদানিকারক ব্র্যান্ডগুলো, আইএলও, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র ও একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলো নতুনভাবে বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকারের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া। বাংলাদেশ সরকারও যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রম আইনগুলোকে শ্রমিকবান্ধব করে সংস্কার করে।
সম্প্রতি তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক সংগঠন বিজিএমইএ তাদের ২০২১ সালের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে ও ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে। রোডম্যাপে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা ও অন্য বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই প্রাধান্য পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে চীনের পরেই অবস্থান করে নিয়েছে। এ সাফল্য মালিক-শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত চেষ্টায়ই সম্ভব হয়েছে। তবে রানা প্লাজা পরবর্তী সময়ে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের উন্নতির ব্যাপারে সবার স্বীকৃতি পেলেও শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারে আমদানিকারক দেশগুলোর ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলোর উৎকণ্ঠা কিছুটা রয়েই গেছে। বিশ্ববাজারে বর্তমান অবস্থা বজায় রাখতে বা আরও এগিয়ে যেতে হলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বিশেষ করে পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বড় বাজার ইইউতে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধার সঙ্গে যখন শ্রমিকদের অধিকার সরাসরি জড়িত রয়েছে। এ ছাড়া আগামী দশকে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সঙ্গে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সূত্রপাত ঘটবে যেমন জিএসপির শিথিল রুল অব অরিজিন হারিয়ে ফেলা। সে ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভরতা কমানোর জন্য বস্ত্রশিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অতীতে যেমন সব বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে, আগামী দিনগুলোও সে রকমই আশা করা ভুল হবে না।

 জিল্লুল হাই রাজী: সাবেক বাণিজ্য উপদেষ্টা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ডেলিগেশন বাংলাদেশ।