রাজ গোখরা, রাসেলস ভাইপার, পদ্ম গোখরা, খৈইয়া গোখরা, কালাচ, শঙ্খিনী, কালকেউটে, দাঁড়াশ, অজগর, ঘরগিন্নি, ঢোড়া, বেত আচরা, কালনাগিনী, বালি, কমলাবতীসহ দেশে প্রায় ৯০ প্রজাতির সাপ আছে। বিভিন্ন সময়ে সাপ মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। আর সাপের নাম শুনলেই যেমন গা শিউরে ওঠে, তেমনি অনেকে লাঠি হাতে নেন মারার জন্য। এ ধরনের পরিস্থিতিতে একদল তরুণ ওই সাপ উদ্ধার করেন। যে সাপ প্রকৃতির যে ধরনের পরিবেশে থাকে, সেটিকে সেই পরিবেশে ছেড়ে দেন তাঁরা।
উদ্ধারকারী তরুণদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মো. মাহফুজুর রহমান, সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া, তামান্না ইসরাত, কে এইচ নেওয়াজ। তাঁরা বেসরকারি সংস্থা ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের (ডিইএসআরএফ) সদস্য। মাহফুজুর রহমান এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
সম্প্রতি প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে এই তরুণদের সঙ্গে কথা হয়। কথা প্রসঙ্গে হাসতে হাসতে জানালেন, তাঁরা শুধু সাপ নয়, সব ধরনের বন্য প্রাণী উদ্ধার করেন। তবে সব জায়গায় ঘুরেফিরে আলোচনায় সাপের প্রসঙ্গটি প্রাধান্য পায়।
বন অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বশে মানুষ উপকারী অনেক সাপ মেরে ফেলছে। সাপের প্রধান খাদ্য ইঁদুর। ইঁদুর খেয়ে সাপ কৃষকের বন্ধু হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে ৯০ প্রজাতির মধ্যে ২৬ প্রজাতির সাপ বিষধর। এর মধ্যে আছে ১০ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ, যা মানুষের আশপাশে থাকে না। সাপ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সাপ নিজে আক্রান্ত না হলে মানুষকে কামড় দেয় না।
শুধু সাপ উদ্ধার নয়, এই তথ্যগুলোই মানুষের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন ডিইএসআরএফের সদস্যরা। সাপ ভয়ংকর— নাটক ও সিনেমাসহ সব জায়গায় এভাবে প্রচার করা হয়। তাই কমবেশি অনেকের মধ্যে সাপ নিয়ে ভীতি কাজ করে। তাই সাপ নিয়ে কাজ করার জন্য এই সংগঠনের সদস্যদের সবার আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান জানান, ২০১৮ সাল থেকে সংগঠনের যাত্রা শুরু। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে এটি যাত্রা শুরু করে। তবে বর্তমানে সারা দেশেই সংগঠনের সাড়ে ৫০০ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের প্রাইভেট গ্রুপে সাপের ক্ষতি না করে উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়ার পক্ষের মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখের বেশি। সংগঠনের উদ্ধারকারী দলে অর্থাৎ বন্য প্রাণী উদ্ধারে সরাসরি অংশ নিচ্ছেন ১০ জন, এর মধ্যে রয়েছেন ২ জন নারী। উদ্ধারকারীদের জন্য প্রশিক্ষণ চলছে। সেখান থেকেও নানা পর্যায়ের যাচাই–বাছাই শেষে উদ্ধারকর্মী হিসেবে তাঁরা দলে যোগ দেবেন।
মাহফুজুর রহমান জানান, সাপ দেখতে পাওয়ার তথ্য জানিয়ে রাত তিনটার সময়েও সংগঠনের হটলাইনে ফোন আসে। ফোন পাওয়ার পর সদস্যরা দ্রুত সময়ে সেই জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের প্রথম কাজ—সাপ যে বাড়ি বা যে জায়গায় আটকা পড়েছে, সেই জায়গার মানুষকে শান্ত থাকার অনুরোধ করা এবং সাহস দেওয়া যে সাপকে আক্রমণ না করলে সেটি কাউকে কিছু করবে না। ঘর বা যে জায়গায় সাপ রয়েছে, সেখান থেকে মানুষকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন তাঁরা। তবে অনেক ক্ষেত্রে তথ্য পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মানুষ সাপটি মেরে ফেলে।
সংগঠনের প্রচার সম্পাদক ও উদ্ধার শাখার পরিচালক সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া বলেন, সাপ দেখলেই মানুষ লাঠি খোঁজে। অথচ সাপ মারতে গিয়ে বেশির ভাগ সময় মানুষ এর কামড় খাচ্ছে। অন্যদিকে বেশির ভাগ মানুষ সাপের কামড় খেয়ে ওঝা বা অন্য উপায়ে ভালো হতে চান। কামড় খাওয়ার ১০০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি—এ তথ্যও অনেকের কাছে নেই বা অনেকে তা মানতে চান না। অন্যদিকে বেদে সম্প্রদায়ের অবৈজ্ঞানিক অপচিকিৎসা তো আছেই।
আপনারা আধুনিক সাপুড়ে কি না প্রশ্ন করলে সংগঠনের সমাজকল্যাণ সম্পাদক তামান্না ইসরাত বলেন, ‘আমরা সাপপ্রেমী। সাপুড়েরা সাপ নিয়ে ব্যবসা করেন। সাপ আটকে রাখেন। আমরা আটকে রাখা সাপ উদ্ধার করে সেটিকে আবার তার পরিবেশে ছেড়ে দিয়ে আসি। সাপের মণি বলে কিছু নেই, সাপ দুধ খায় না, সব সাপ বিষধর নয়—এ ধরনের তথ্যগুলো দিয়ে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করি।’
বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের ২০২০-২০২১ অর্থবছরের তথ্য বলছে, এ সময়ে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় মোট ৬৯৭টি সাপ উদ্ধার করা হয়েছে। সাপ উদ্ধারে বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিরা কাজ করছেন। তবে সব সাপ উদ্ধারের তথ্য এ ইউনিটের তালিকায় তালিকাবদ্ধ হচ্ছে না।
সাপের কামড়ে বছরে কত মানুষ মারা যাচ্ছেন, তার সরকারি কোনো হিসাব নেই। তবে বেসরকারি হিসাবে ×ছয় হাজারের বেশি মৃত্যুর তথ্য দেওয়া হয়। প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে তরুণ উদ্ধারকারীরা বলেন, সাপ নিয়ে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে মানুষের মারা যাওয়ার সংখ্যাটি তাঁরা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। একইভাবে গণমাধ্যমের সংবাদে, সিনেমা বা নাটকে সাপকে যাতে ভয়ংকরভাবে বা ভুল তথ্য দিয়ে উপস্থাপন করা না হয়, সে দিকটি নিয়েও তাঁরা কাজ করতে চাচ্ছেন।
মাহফুজুর রহমান ২০১৩ সাল থেকে সাপ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করছেন। এ জন্য তাঁর বাসার সদস্যরা তাঁকে হুজুরের কাছেও নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন সাপ নিয়ে জানার জন্য তেমন বইও ছিল না। তবে এখন বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরা তাঁর এ কাজে সহযোগিতা করছেন। মাহফুজুর জানালেন, ডিপ ইকোলজি একটি দার্শনিক মতাদর্শ। এর মূল কথা হচ্ছে, সব জীবের সমান অধিকার ও মূল্য আছে।
সাভারে ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে উদ্ধার করা সাপ রাখা হয়। এরপর যত দ্রুত সম্ভব সেটি ছেড়ে দেওয়া হয়। সাপ বিষধর হলে বন অধিদপ্তরের সঙ্গে পরামর্শ করে সেটিকে উপযুক্ত স্থানে নিয়ে অবমুক্ত করা হয়। এ সংগঠনের উপদেষ্টাদের মধ্যে বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ব্যক্তি উদ্যোগে সাপ উদ্ধারকারী ব্যক্তিসহ বিভিন্ন মানুষ যুক্ত রয়েছেন।
উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা বলেন, একটি সাপকে যখন ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটি তার নিজের জায়গায় যাচ্ছে, তা ভেবে খুব খুশি লাগে। তাঁরা জানান, তাঁদের সংগঠনটি নিবন্ধনের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এখন পর্যন্ত উপদেষ্টাসহ সংগঠনের সদস্যদের নিজেদের চাঁদায় চলছে উদ্ধার কার্যক্রম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ল অ্যান্ড জাস্টিস বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া। তিনি চলতি বছরেই প্রশিক্ষণ নিয়ে সংগঠনের উদ্ধারকারী দলের প্রথম নারী সদস্য হিসেবে মাঠে কাজ শুরু করেন। এর আগে দুই বছর বিভিন্ন উদ্ধারকাজে পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। জানান, তাঁর মা সাপকে প্রচণ্ড ভয় পান। মানুষজনও বলেন, আইন পড়া বাদ দিয়ে মেয়ে সাপ ধরে বেড়াচ্ছে। উদ্ধারকাজে গেলে অনেক সময় যে বাড়িতে সাপ আটকা পড়েছে, ওই বাড়ির সদস্যরাও বলেন, আপনি মেয়েমানুষ, আপনি গ্যারেজে বসেন, ভেতরে গিয়ে কাজ নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তামান্না ইসরাতও একসময় সাপ নিয়ে বিভিন্ন পৌরাণিক গল্প বা সিনেমায় যেভাবে সাপকে দেখানো হয়, তা বিশ্বাস করতেন। তবে আস্তে আস্তে সাপ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে বুঝতে পারেন, সাপকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তাতে বেশ ঝামেলা আছে। বিষয়টি নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে তাঁরও একসময় ‘যুদ্ধ’ করতে হলেও এখন তাঁরাই মনে করেন মেয়ে ভালো কাজ করছে।
সংগঠনটির যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক কে এইচ নেওয়াজ সাভার কলেজে মার্কেটিং বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর পরিবার প্রথমে এ কাজে বেশ অবাক হলেও আপত্তি করেনি কখনো। সংগঠনে তিনিই বয়সের দিক থেকে সবার ছোট।
১০ অক্টোবর রাত ১১টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি গেট–সংলগ্ন এলাকা থেকে সাপ উদ্ধারের ফোন পান মাহফুজুর ও তাঁর দলের সদস্যরা। তারপর শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। উদ্ধার করা সাপটি ছিল তীব্র বিষধর কালকেউটে। এ উদ্ধার অভিযানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান ও অধ্যাপক কামরুল হাসান প্রমুখ বিভিন্নভাবে যুক্ত ছিলেন। বন বিভাগের অনুমতিতে পরে সাপটিকে অবমুক্ত করা হয়েছে।
অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ঢাকা ওয়াসা কার্যালয় থেকে বেশ কয়েকটি সাপ উদ্ধারের খবর গণমাধ্যমে আসে। বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট অফিস ও ডিইএসআরএফের সদস্যরা জানান, ওয়াসা ভবন থেকে উদ্ধার করা সাপগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে গণমাধ্যম থেকে তাঁরা জেনেছেন। অথচ ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সাপের খবর জানালে হয়তো জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হতো।
বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী সাপ শিকার, হত্যা, আটক, কেনাবেচা বা পরিবহন দণ্ডনীয় অপরাধ। বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এ এস এম জহির উদ্দিন আকন প্রথম আলোকে বলেন, দেশে প্রায় ২০ জন আছেন যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে সাপ ও অন্যান্য বন্য প্রাণী উদ্ধারে অংশ নিচ্ছেন। একইভাবে ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের মতো বেশ কিছু বেসরকারি সংগঠন সরকারের সহযোগী হিসেবে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করছে। ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোকে স্বীকৃতি দিতে সরকার নীতিমালা করার পরিকল্পনা করছে। জহির উদ্দিন আকন বলেন, ‘মাহফুজুরসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক বলতে গেলে আমাদের কাজটিই করে দিচ্ছেন।’
আকিজ ওয়াইল্ডলাইফ ফার্ম লিমিটেডের ইনচার্জ এবং ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন উপদেষ্টা, প্রশিক্ষক ও উদ্ধারকারী আদনান আজাদ গত ২০ বছরে প্রায় ৫০০ সাপ একাই উদ্ধার করেছেন। তিনি জানান, ফেসবুকে মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে পরিচয়। দুজনে একই কাজ করছেন, তাই একটি সংগঠনের মাধ্যমে করলে তা বেশি ভালো হবে বলে প্রস্তাব দেন মাহফুজুর।
আদনান আজাদ, মাহফুজুরসহ দলের সদস্যরা বলেন, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মানুষ তাঁদের কথা স্মরণ করছেন, ভরসা করছেন, এটিই অনেক পাওয়া। দলের সদস্যদের কথা—ভালো থাকুক মানুষ, ভালো থাকুক প্রকৃতির সন্তানেরা। এই সংগঠনের হটলাইন নম্বর ০১৭১৮৪১৪৫১৭।