একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২০১৫ সালের নভেম্বরে। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। কিন্তু সরকারের প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় তাঁর নাম নেই।
একইভাবে নোয়াখালীর ২৫ রাজাকারের যে তালিকা প্রকাশ হয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া রাজাকার আমির আলীর নামও ওঠেনি। কক্সবাজারে যে পাঁচজনের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের চেনেন না স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। অথচ জেলার চিহ্নিত রাজাকারদের নাম না দেখে হতাশ এলাকাবাসী।
১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথম দফায় ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে।
মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক মাহফুজুর রহমান ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। কিন্তু রাজাকারের তালিকায় তাঁর নাম ওঠেনি। এটা বিস্ময়কর।
মাহফুজুর রহমান আরও বলেন, রাজাকারের তালিকা ভুয়া বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের উচিত, এই তালিকা বাতিল করে কমিটি গঠনের মাধ্যমে নতুন তালিকা প্রণয়ন করা। গ্রামে গ্রামে বেঁচে থাকা সব মুক্তিযোদ্ধাকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকারদের চিহ্নিত করা যায়। এই কাজ করতে ছয় মাসের বেশি লাগবে না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি অশোক সাহা মনে করেন, সরকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপশক্তি রাজাকারের তালিকা তৈরি করেছে। তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে।
এদিকে কক্সবাজার প্রশাসনের কাছে রাজাকারের তালিকা নেই। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাছেও নেই কোনো নথিপত্র। তবে কয়েক বছর সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে রাজাকারনামা নামে একটি বই প্রকাশ করেন কক্সবাজারের লেখক কালাম আজাদ। বইটিতে কক্সবাজারে শান্তিকমিটি, রাজাকার, আলশামস ও আলবদর মিলে ১ হাজার ৬৩৪ জনের পরিচয় তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে উখিয়ায় ১৩৬, চকরিয়ায় ৫৫, কুতুবদিয়ায় ১৩০, মহেশখালীতে ৪০, কক্সবাজার সদরে ১৫৬, রামুতে ১৩৭, পেকুয়ায় ১৭ ও টেকনাফে ৩৯ জনের নাম রয়েছে।
তালিকায় কক্সবাজারের চিহ্নিত রাজাকারদের নাম না দেখে অনেকে হতাশ বলে জানান কক্সবাজার জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুহাম্মদ শাহজাহান। তিনি বলেন, প্রথম দফায় তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তাদের পরিচয় কেউ শনাক্ত করতে পারছে না।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তালিকায় রয়েছে মহেশখালীর দুই রাজাকারের নাম। তাঁরা হলেন আইয়ুব হোসেন মণ্ডল ও আলতাফ হোসেন। তাঁদের নামের পাশে মন্তব্যের ঘরে লেখা হয়েছে ‘মামলা প্রত্যাহার।’ কিন্তু মহেশখালীতে এ নামে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মহেশখালী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মহেশখালীতে রাজাকার ছিল ৪০ জন। এর মধ্যে মৌলভি জাকারিয়া, হাশেম সিকদার, মৌলভি হেলালসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা বিচারাধীন। আইয়ুব হোসেন মণ্ডল ও আলতাফ হোসেন নামে কোনো রাজাকার মহেশখালীতে আছে কি না, জানা নেই।
তালিকায় টেকনাফের রাজাকার হিসেবে আবদুল জলিল ও আবু বক্করের নাম আছে। গত দুই দিন এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের কারও পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। এ প্রসঙ্গে টেকনাফের মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হুদা বলেন, টেকনাফের চিহ্নিত রাজাকার ৩৯ জন। তাদের কারও নাম তালিকায় নেই। আর যাদের নাম তালিকায় এসেছে তাদের কেউ চেনে না।
নুরুল হুদা বলেন, তবে মৌলভি আবদুল জলিল নামে একজন রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। তাঁর বাড়ি টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের মুন্ডারডেইল খুরেরমুখ এলাকায়। দেশ স্বাধীন হলে তিনি দলবল নিয়ে আত্মসমর্পণও করেছিলেন। আবদুল জলিল ওই মৌলভি আবদুল জলিল হতে পারে। তবে আবু বক্কর নামে কোনো রাজাকারকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না।