রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংরক্ষিত কোটায় গত তিন বছরে বিভিন্ন আকারের প্লট পেয়েছেন অন্তত ২৮৫ জন। তাঁদের মধ্যে ১৪৯ জনই সাবেক ও বর্তমান সাংসদ। বাকিদের মধ্যে আছেন উচ্চপর্যায়ের আমলা থেকে শুরু করে অফিস সহকারী, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রীও আছেন।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও জনসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্লটগুলো দেওয়ার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য ও রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে ঢাকায় বাড়ি, প্লট ও ফ্ল্যাট আছে; এমন সাংসদও রয়েছেন যাঁরা বিশেষ কোটায় রাজউকের প্লট পেয়েছেন। রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁরা কেবল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসরণ করেছেন।
রাজউকের গত তিন বছরের (২০১৮-২০) প্লট বরাদ্দের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংরক্ষিত কোটায় প্লটগুলো দেওয়া হয়েছে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প, ঝিলমিল আবাসন প্রকল্প, উত্তরা তৃতীয় পর্ব এবং উত্তরা আবাসিক এলাকায়। কয়েকজনকে যৌথভাবে একই প্লট বরাদ্দ দেওয়ায় ২৮৫ জনকে দেওয়া প্লটের সংখ্যা ২৪৯টি। তার মধ্যে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প থেকেই দেওয়া হয়েছে ২১২টি প্লট।
রাজউকের সূত্রগুলোর মতে, বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা পদক পাওয়া একজন সাঁতারু, একুশে পদক পাওয়া একজন কবি আছেন। যাঁরা এই কোটায় প্লট বরাদ্দ পাওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন। কিন্তু অনিয়ম ভোগান্তির ভূরি ভূরি অভিযোগ যে রাজউকের নামে সেই সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান দুজন চেয়ারম্যানও প্লট নিয়েছেন জনসেবার মান বাড়ানোর কথা বলে। ডেপুটেশনে থাকা রাজউকের কর্মকর্তাও প্লট নিয়েছেন বিশেষ কোটায়।
এক সভায়ই প্লট পান ৯৯ সাংসদ
প্লট পাওয়া ২৮৫ জনের ২৪০ জনই প্লট পেয়েছেন ২০১৮ সালে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। এর মধ্যে ওই বছরের ৫ম বোর্ড (৫/২০১৮) সভায় বরাদ্দ পেয়েছেন ৯৯ জন সাংসদ, তাঁদের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ আছেন ৩৬ জন। তাঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের সাংসদ। বাকিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় পার্টি (জেপি), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও তরীকত ফেডারেশনের সাংসদ রয়েছেন। ২০১৪ সালে ঢাকা–১৭ আসনে সাংসদ নির্বাচিত হওয়া বিএনএফের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদও প্লট পেয়েছেন।
রাজউক থেকে পাওয়া নথি অনুযায়ী, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে ৯৯ জন সাংসদের নামের একটি তালিকা পাঠানো হয়। রাজউক বিধি অনুসরণের কথা বলে পূর্বাচলে ৯৫ জন এবং ঝিলমিলে চারজনকে প্লট বরাদ্দের বিষয়টি চূড়ান্ত করে।
প্লট পাওয়া ২৮৫ জনের ২৪০ জনই প্লট পেয়েছেন ২০১৮ সালে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। এর মধ্যে ওই বছরের ৫ম বোর্ড (৫/২০১৮) সভায় বরাদ্দ পেয়েছেন ৯৯ জন সাংসদ, তাঁদের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ আছেন ৩৬ জন।
কিন্তু রাজউকের বিধি এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রাজউকে পাঠানো একটি চিঠি— স্মারক নং–প্রশা–৬/রাজ–৬৬/৯৮/১১৪/১(১১৩) অনুযায়ী, প্লট পাওয়ার জন্য আবেদনকারী ব্যক্তির নিজের নামে, স্বামী/স্ত্রীর নামে কিংবা পরিবারের সদস্যের নামে রাজউকের আওতাধীন এলাকায় কোনো আবাসিক জমি, বাড়ি, প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ কিংবা লিজ পেয়ে থাকলে তিনি সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ পাবেন না। এমনকি আবেদনকারী উত্তরাধিকার বা ক্রয়সূত্রে কোনো জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হলেও তিনি সংরক্ষিত কোটায় প্লট বরাদ্দ পাওয়ার অযোগ্য হবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিকের মতে, এই বিধান সাংসদসহ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। এই বিধানের লঙ্ঘন করা নিঃসন্দেহে বেআইনি।
কিন্তু গত তিন বছরে প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত সাংসদের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একাধিক সাংসদের নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকা শহরে এক বা একাধিক ফ্ল্যাট আছে। জমির মালিকও আছেন কয়েকজন।
তাঁদের মধ্যে আছেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারও। তিনি পূর্বাচলে একটি প্লট পেয়েছেন। কামাল আহমেদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা শহরে তাঁর পৈতৃক বাড়ি আছে।
তাহলে রাজউকের প্লটের জন্য আবেদন করলেন কেন? জবাবে কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, সব সাংসদই রাজউকের প্লট পান। তাঁর দাবি, আগে একটি আইন ছিল যে ঢাকায় বাড়ি থাকলে প্লট পাওয়া যাবে না, কিন্তু সেই নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে। এরপরই তিনি প্লটের জন্য আবেদন করেছিলেন। মিরপুর এলাকার দুজন সাংসদসহ কয়েকজন সাংসদের নাম উল্লেখ করে বলেন, ঢাকায় বাড়ি থাকার পরও তাঁরা প্লট নিয়েছেন।
সরকারদলীয় এই সাংসদ বলেন, তিনি ১০ কাঠার প্লট চেয়েছিলেন, কিন্তু ৩ কাঠার দেওয়া হয়েছে। তাই তিনি নেননি। তিনি এটা পরিবর্তন করে ১০ কাঠা দেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।
জাতীয় পার্টির রাজনীতিকদের মধ্যে ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত সাবেক মন্ত্রী ও সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনিও পূর্বাচলে সাড়ে ৭ কাঠার একটি প্লট নিয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, স্ত্রীর নামেই ২০টি ফ্ল্যাট আছে। ধানমন্ডিতে বাড়ির কথা নিজেই প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন। ফিরোজ রশীদের দাবি, সব সাংসদই প্লট পেয়েছেন। ঢাকায় বাড়ি–জমি থাকলে প্লট পাওয়া যাবে না, এমন বিধান সাংসদদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
রাষ্ট্রীয় ও জনগুরুপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদান বিবেচনায় নিয়ে বিধি মেনেই প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। কার কী অবদান আছে, সেটি মন্ত্রণালয় ও রাজউক উভয় পর্যায়ের যাচাই-বাছাই হতে পারে।মো. শহীদ উল্লা খন্দকার, সচিব, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়
একইভাবে মুন্সিগঞ্জ–১ আসনের সাংসদ সুকুমার রঞ্জন ঘোষ পূর্বাচলে ৩ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। অথচ নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তাঁর হলফনামায় বলেছেন, তাঁর নিজের নামে গাজীপুরের জয়দেবপুরে ২৭ শতাংশ, ঢাকার নিকুঞ্জ-১–এ ৩ কাঠা, মালিবাগে আড়াই কাঠা জমি আছে। স্ত্রীর নামে ধানমন্ডিতে একটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে, নির্ভরশীলের নামে একই এলাকায় আরও একটি প্লট আছে।
নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরেরই ৯টি ফ্ল্যাট আছে জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ মো. শওকত চৌধুরীর (সম্প্রতি তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন)। তিনিও পূর্বাচলে ৩ কাঠার একটি প্লট পেয়েছেন। কোন ‘বিশেষ অবদানের’ স্বীকৃতি হিসেবে রাজউকের প্লট বরাদ্দের বিধিমালা অনুযায়ী প্লট পেয়েছেন, জানতে চাইলে শওকত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো অবদান নাই, এমপি হলেই প্লট পাওয়া যায়। আগে ১০ কাঠার দিত, এখন ৩ কাঠা দেয়।’
রাজউকের প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত বিধিমালা (১৯৬৯) অনুসারে, রাজউক কোনো আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করলে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষকে প্লট বরাদ্দ দেয়। এর বাইরে কিছু প্লট সরকারের জন্য সংরক্ষিত রাখে, যা সংরক্ষিত কোটার প্লট নামে পরিচিত।
বিধিমালার ১৩(এ) ধারা অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে অবদান, জনসেবা ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান বিবেচনায় নিয়ে এই কোটায় প্লট পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে বরাদ্দ পেতে আগ্রহী ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী কিংবা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সরকার বরাবর আবেদন করতে হয়। সরকারের অনুমোদন পেলে সেটি রাজউকের বোর্ড সভায় বা সাধারণ সভায় উত্থাপন করতে হয়। বোর্ড সভায় প্লট বরাদ্দের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
সংরক্ষিত কোটার [১৩(এ) ধারা] অপব্যবহারের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) মো. শফি উল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ১৩(এ) ধারায় এককভাবে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষমতা রাজউকের নেই। মন্ত্রণালয় থেকে যে নাম বা তালিকা পাঠানো হয়, সে অনুযায়ী রাজউক বরাদ্দ দেয়।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গৃহায়ণ ও গণপূর্তের দায়িত্বে আছেন প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ। তিনিও ৩ কাঠার একটি প্লট নিয়েছেন। তিনি ফোনে কথা বলতে রাজি হননি। তবে এই মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রীয় ও জনগুরুপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদান বিবেচনায় নিয়ে বিধি মেনেই প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। কার কী অবদান আছে, সেটি মন্ত্রণালয় ও রাজউক উভয় পর্যায়ের যাচাই-বাছাই হতে পারে। তিনি বলেন, তারপরও কোনো প্লট বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধির লঙ্ঘন হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। সাংসদদের জন্য আলাদা কোনো কোটা নেই।
ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট নেই
রাজউকের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প হচ্ছে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প। রাজউকের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পূর্বাচলে সংরক্ষিত কোটায় ১০ শতাংশের মতো প্লট রাখা হয়েছিল। অনেক আগেই সেই কোটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই এখনো প্লট পাননি। রাজউকের বিধিমালা অনুযায়ী, যাঁদের জমি বা বাড়ি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে তাঁরা অগ্রাধিকার পাবেন।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, পূর্বাচলে ক্ষতিগ্রস্ত বা মূল আদিবাসী শ্রেণিতে (এখনো যাঁরা বরাদ্দ পাননি) প্লটের জন্য মোট ৩ হাজার ৫৫৪টি আবেদন জমা পড়েছিল। যাচাই শেষে ১ হাজার ৪৫৩টি আবেদন যথাযথ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু বাস্তবে পূর্বাচলে এখন আর বরাদ্দ দেওয়ার মতো এত প্লট নেই।
রাজউকের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প হচ্ছে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প। রাজউকের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পূর্বাচলে সংরক্ষিত কোটায় ১০ শতাংশের মতো প্লট রাখা হয়েছিল। অনেক আগেই সেই কোটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই এখনো প্লট পাননি।
নাম না প্রকাশের শর্তে রাজউকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট দিতে পূর্বাচলের ১৫ ও ২৮ নম্বর সেক্টরে অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের জন্য নির্ধারিত প্রায় ৮৯ একর জায়গার নকশা পরিবর্তন করে সেখানে ১ হাজার ১৯৭টি প্লট (প্রতিটি ৩ কাঠা করে) সৃজনের উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক। কিন্তু এ জন্য আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হবে। নকশা সংশোধন নিয়ে পরিবেশবাদীদের একটি মামলা আছে।
রাজউকে ক্ষোভ
রাজউকের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের একটি অংশ মনে করেন, প্লট বরাদ্দ–সংক্রান্ত ১৩(এ) ধারার অপব্যবহার হচ্ছে। দীর্ঘদিন রাজউকে চাকরি করেও অনেকে প্লট পাননি। এ নিয়ে তাঁরা ক্ষুব্ধ। এ অংশের দাবি, সংরক্ষিত কোটার মতো তাঁদের জন্যও প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে একটি বিধিমালা করা হোক।
প্লট বরাদ্দ–সংক্রান্ত ১৩(এ) ধারার অপব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। যাঁরা প্লট পাচ্ছেন, তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ কোনো অবদান রেখেছেন বলে জানা নেই। এটি বন্ধ হওয়া উচিত।