প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার ও হয়রানির প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে সর্বস্তরের সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ। গতকাল সোমবার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নানাভাবে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তাঁরা। অবিলম্বে তাঁর মুক্তির দাবি করেছেন তাঁরা।
অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দীন মাহমুদ লেখেন, ‘দুর্নীতি কি “official secret”-যে আইনে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হলো? বাংলাদেশের দুর্নীতি কি বিশ্বব্যাপী কোনো গোপন বিষয়? দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা তো সরকারের জবাবদিহির জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি, কারণ শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে জবাবদিহি ছাড়া কোনো দেশের উন্নয়ন টেকসই হয়নি—গণতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী যেকোনো ধরনের শাসনব্যবস্থাই হোক।’
এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও ‘আজকের পত্রিকা’র সম্পাদক গোলাম রহমান লেখেন, ‘সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটক রেখে নির্যাতন করার অধিকার কে দিল? নির্যাতনকারীদের বিচার চাই। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান লেখেন, ‘কোনো হিসেবেই, কোনো যুক্তিতেই, কোনো অজুহাতেই নির্ভীক ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনার প্রকাশ্য হেনস্তা ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔপনিবেশিক গোপনীয়তা আইনের মাধ্যমে আইনি হয়রানি গ্রহণযোগ্য নয়, হতে পারে না। এটি নারীর অপমান, এটি সাংবাদিকতা পেশার অপমান, এটি মর্যাদাপূর্ণ মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ স্বপ্নের অপমান, এটি সরকারি শুদ্ধাচার নীতিমালার অপমান। অবিলম্বে এই হেনস্তার অবসান চাই। “ওয়ার্কিং মাদার” রোজিনাকে অনতিবিলম্বে ওর সন্তানের সঙ্গে মিলিত হওয়া নিশ্চিত করা হোক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে কেউই নয়, বিশেষ করে দুর্নীতিগ্রস্ত দায়িত্বপ্রাপ্তরা।’
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ প্রিজন ভ্যানের ভেতরে থাকা সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের একটি ছবি পোস্ট করে লেখেন, ‘এই ছবির মাধ্যমে পাঠানো বার্তা হিমশীতল ও পরিষ্কার। মিডিয়ার বস্তুনিষ্ট সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতাটুকুও যদি আর না থাকে, তাহলে কোথায় যাবো আমরা? রোজিনা ইসলামের মুক্তি চাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল এই ঘটনার প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি পোষ্ট দেন। এর মধ্যে একটিতে তিনি লেখেন, ‘সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে লেখার অধিকার, চোরদের গোপনীয়তার অধিকারের চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান।’
আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি এম ইকবাল আর্সলান লেখেন, ‘একজন সাংবাদিকের পেশাগত ও নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে সত্যের সন্ধান, উদ্ঘাটন এবং জনসমক্ষে প্রকাশ/উপস্থাপন। সারা বিশ্বজুড়েই সাংবাদিকেরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য অনেক পথ অবলম্বন করে থাকেন, তাই বলে তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, আটকে রাখা থেকে গ্রেপ্তার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রোজিনা একজন স্বনামধন্য সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি তাঁর সাংবাদিকতার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে পুরস্কৃত, তাঁর সঙ্গে আজ যা ঘটল, তা অবাধ তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হলো। পেশাজীবী হিসেবে এটা কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, ‘ঘুরে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। রোজিনা আমাদের স্বর। আমাদেরই গলা চেপে ধরা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আরেক অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘কানুনের অসভ্য হাত এভাবে ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে। চাইলে প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র সাংবাদিকের যেকোনো কার্যক্রমকে “অপরাধ” হিসেবে শনাক্ত করে মামলা ঠুকতে পারে। তারা দয়া করে মামলা করে না, সব ক্ষেত্রে। কিন্তু সাংবাদিকেরা এগুলো মানবে কেন? সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যতটুকু দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে এই আইনগুলো তো সাংঘর্ষিক। আর এগুলো পরোয়া করলে তো সাংবাদিকতা আদৌ করা যাবে না। সব সংবাদপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে হবে!... সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজ রোজিনাকে উদ্ধার করতে কতটুকু রাস্তায়, কতটুকু চিন্তায়, কতটুকু কর্মে সক্রিয়তা প্রদর্শন করতে পারছে, তার ওপর নিকট ভবিষ্যতের অনেক কিছু নির্ভর করছে। তার মধ্যে এটাও থাকবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অসভ্য (রোজিনার প্রতিবেদনে এসেছে তারা দুর্নীতিবাজও) আমলা, যারা রোজিনাকে বেআইনিভাবে আটকে রেখেছে, অসুস্থ করেছে, চিকিৎসাবঞ্চিত রেখেছে, তাদের সোজা আইনগুলো দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা। আজ, এক্ষুনি রোজিনা ইসলামের মুক্তি দাও।’
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, ‘আলোচনা এটা হওয়া উচিত নয় যে জামিন হবে কি না, বরং আমাদের আলাপ হওয়া উচিত যাঁরা নির্যাতন করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবেন কীভাবে?’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল বলেন, ‘রোজিনা ইসলামের সঙ্গে স্বাস্থ্যসচিবের স্টাফদের আচরণ এই মন্ত্রণালয়ের সকল লুটপাট ও কলঙ্কের মধ্যে নিকৃষ্টতম একটি ঘটনা। সাংবাদিকদের ফাইল ধরে টানাটানি করতে হয় না। সকল তথ্য সরকারের লোকেরাই সরবরাহ করে থাকে। এর নিন্দা জানাই, পদস্থদের শাস্তি চাই।’
ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের এডিটর ইন চিফ এম শামসুর রাহমান লেখেন, ‘৯০ এর মাঝামাঝি ডেইলি স্টারে বিজনেস রিপোর্টার হিসেবে আমি আমার কর্মজীবন শুরু করি। আমার অনেকগুলি প্রতিবেদন ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ নথির ওপর ভিত্তি করে ছিল, যা আমার সূত্রই আমাকে দিয়েছিল। সে সময় থেকেই আমি গোপন নথি, গোপনীয় মন্ত্রিসভা সংক্রান্ত প্রতিবেদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিকিউরিটিস এবং এক্সচেঞ্জ কমিশন, বেসরকারীকরণ বোর্ড, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ নানা প্রতিবেদনের ছবি তুলে নিতাম। তবে উৎস বা কীভাবে পেলাম সে সম্পর্কে আমাকে কোথাওই কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি। এই ২০২১ সালে এসে আমার সহকর্মী রোজিনা ইসলামকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা হচ্ছে। কেন? মোবাইল দিয়ে সংবেদনশীল কিছু তথ্যের ছবি তোলার জন্য। যদি তাকে এ কারণেই বিচার করা হয় তবে অবশ্যই আমাকে স্বীকার করতে হবে যে আমরা সব সাংবাদিকই একই অপরাধে দোষী। আমাদের সবারই বিচার হওয়া উচিত এবং ওই শিকের পেছনে থাকা উচিত।’
জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দীন তাঁর পোস্টে লেখেন, ‘ঢাকার নয়টি হাসপাতালের কেনাকাটার অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে ডয়চে ভেলেতে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেই প্রতিবেদনগুলো একটি সরকারি নথির ভিত্তিতেই করা হয়েছে। সেটিও আমরা চুরি করেছি। রোজিনার বিরুদ্ধে চুরির দোষে মামলা হলে আমার বিরুদ্ধেও সেই নথি চুরির মামলা দেন।’
ডয়চে ভেলের আরেক সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম পোস্ট দেন, ‘সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে হেনস্তা করার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি হওয়া জরুরি।’
‘হ্যাশট্যাগ ফ্রিরোজিনাইসলাম’ দিয়ে সাংবাদিক প্রণব সাহা লেখেন, ‘গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ নতুন কিছু নয়, সবাই চান সংবাদমাধ্যম আমার পক্ষে থাকবে। অনেকে থাকেও হয়তো, কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গলা টিপে একজন সাংবাদিককে হত্যার চেষ্টা, তা মেনে নেব না। অসুস্থ রোজিনার চিকিৎসা সবার আগে হতে হবে। আরও দাবি মামলার আগে আটকে রেখে হত্যাচেষ্টার বিচার চাই।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় নেতা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের পক্ষে বাংলাদেশ। দুর্নীতি, অনিয়ম, অন্যায়, অব্যবস্থাপনা প্রতিহত কর। দুর্নীতিবাজ ও এদের প্রশ্রয়দানকারীদের ক্ষমা নেই। সাংবাদিক নির্যাতনসহ সব ধরনের নির্যাতন রুখে দাঁড়াও। নির্যাতনকারী ও নেপথ্যের হোতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাও। সর্বত্র স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করো। যে নথি কপি করার কথা বলা হচ্ছে, তা জনসমক্ষে উন্মুক্ত করে।’
সাংবাদিক মাহমুদ মেনন খান বলেন, ‘স্বাস্থ্য “সেবা” দপ্তরে রাষ্ট্রীয় গোপন নথি বলে কিছুই থাকার সুযোগ নেই, এই কথাটা আমি দৃঢ় কণ্ঠে বলতে চাই.... ।’
চিকিৎসক তানজিনা হোসেন বলেন, ‘প্রতিটি রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর রোজিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছি, প্রকাশ করেছি। কেন সাবধান করিনি? কেন বলিনি এটা হীরক রাজার দেশ, এখানে মগজধোলাই ছাড়া টেকা যায় না।’
রোজিনা ইসলামের হেনস্তাকারীদের বিচার চেয়ে ডেইলি স্টারের সাংবাদিক আহমাদ ইশতিয়াক লেখেন, ‘প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটক করে হেনস্তা করার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। রোজিনা ইসলাম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করেছে, লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করেছে এটাই কি তার অপরাধ? সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্তাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। মুক্ত সাংবাদিকতার জয় হোক।’
মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) বাংলাদেশ ব্যুরোপ্রধান জুলহাস আলম লেখেন, ‘সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের অনেকের জন্যই আতঙ্কের এক নাম। রোজিনা দেশে সাংবাদিকতাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি সে বিচারে প্রথম সারির একজন সৈনিক। এটাই সত্যি।’