>আগা খান পুরস্কারজয়ী স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমকে নিয়ে লিখেছেন নবীন স্থপতি ফাতিহা পলিন
আমাদের চারপাশের অতিপরিচিত, সাধারণ জিনিসের মধ্যে একটা সহজাত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। অসাধারণ চোখে তা ধরা পড়ে। যত্ন করে তুলে নিয়ে সাজিয়ে রাখেন কেউ। কেউ ব্যবহার করেন নতুন মাত্রা যোগ করে। সৃষ্টিশীলভাবে ফিরিয়ে আনেন অতীত ঐতিহ্য। মেরিনা তাবাসসুম ঠিক এমনই একজন স্থপতি। দারুণ প্রতিভাময়ী, আত্মপ্রত্যয়ী ও পরিশ্রমী। সব সময় সহজ, স্বাভাবিক ও বাহুল্যবর্জিত কাজ করেন। বহু স্থাপনায় তাঁর নামও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেখেশুনে পছন্দ হলেই তিনি কাজে হাত দেন। নিজের স্কেচখাতা নিয়ে নিমগ্ন থাকতে থাকতেই পরিকল্পনাগুলো জেগে ওঠে। পরিকল্পনার ছক আঁকতে আঁকতেই বাদবাকি খুঁটিনাটি আঁকা হয়ে যায় মাথায়। এলিভেশন বা পার্শ্বচিত্রে চলে আসে উপকরণের আকার-প্রকার আর বাকি সব বৃত্তান্ত।
গুছিয়ে কাজ করার অভ্যাস কিন্তু মেরিনা তাবাসসুমের সেই স্থাপত্য পড়াশোনার সময় থেকেই। তখন দেশের একমাত্র প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের আসন ছিল মাত্র ৫০টি। শত শত ছাত্রছাত্রীর ভর্তিযুদ্ধে প্রথম হয়ে শুরু করেছিলেন স্থাপত্য পড়াশোনা। ছাত্র থাকা অবস্থায় অনেকেরই বেগ পেতে হতো নতুন নতুন নকশার সমস্যা সমাধানে। কিন্তু তাঁর কাছে নতুন সমস্যা মানেই নতুন একটি সমাধান। অনেক সময় নির্মাণক্ষেত্রে নানান ত্রুটি-বিচ্যুতির মুখোমুখি হতে হয়, কিন্তু তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর অসাধারণ।
এ সূত্রেই ধরা যাক ২০১৬ সালে ‘আগা খান পুরস্কার’ পাওয়া বাইতুর রউফ মসজিদের কথা। রাজধানীর দক্ষিণখানের ফায়দাবাদে ৭ হাজার ২০০ বর্গফুট জমির ওপর নির্মিত এই মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছে বাংলা ইট আর কংক্রিটে। হাতে তৈরি এই ইটের আকার সাধারণত একটু কমবেশি হয়। যেনতেনভাবে শুরু করে দিলেই তাই চলে না। কাজটি সুসম্পন্ন করতে হলে সুদক্ষ হাতের প্রয়োজন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সুদূর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এক কারিগর নিয়ে আসা হলো এই মসজিদের জন্য। প্রথমে কয়েক দফা নমুনা তৈরি করে তারপর শুরু হলো মূল কাজ। এমনকি মেঝে নিয়েও চলল বিস্তর গবেষণা। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত করা হলো পাথরের গুঁড়ার মোজাইক আর কাচের বিভাজনরেখার সমন্বয়। সুলতানি স্থাপত্যের অনুপ্রেরণায় গড়া এই মসজিদের নকশায় কিন্তু কোনো গম্বুজ বা মিনার নেই। আছে আলো-আঁধারি আর রোদ-বৃষ্টির খেলা। সকাল-বিকেল-রাতের পালাবদলে বদলে যায় অন্দরের আবহ। আপাত দৃষ্টিতে ছাদের কাটাকুটিগুলো এলোমেলো মনে হলেও, লক্ষ করলে দেখা যায়, সেখানে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক ছন্দ। গভীর রাতের নক্ষত্রখচিত বিপুল আকাশ নেমে আসে মসজিদের ছাদে।
এভাবে নানা কিছু একটি সূত্রে বাঁধার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মেরিনার। যশোরের পানিগ্রাম রিসোর্টটিও তা-ই। স্থানীয় কারিগরের তৈরি রোদে শুকানো ইট, গোলপাতার ছাউনি, কাঠ আর বাঁশের আসবাব আর হাতে নকশা করা নকশিকাঁথা দিয়ে সাজানো প্রতিটি কটেজ। পথের ধারে নুয়ে পড়া বাঁশঝাড় যেন স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে আছে। এর এক পাশে কপোতাক্ষের কাকচক্ষু জল, আরেক পাশে বুড়িভৈরব। প্রাঙ্গণজুড়ে দেশজ গাছপালার সমাহার।
ঢাকার বনানীতে পথ চলতে দেখা যায় কমফোর্ট রিভেরি। পথচলতি মানুষ একবার হলেও ফিরে দেখে এর কৌণিক দেয়ালগাথায়। স্থপতির উদ্দেশ্যও কি তা-ই ছিল না? একঘেয়েমির অট্টালিকায় ঘেরা শহরকে তিনি একটি নাগরিক ফাসাদ (ভবনের বহির্ভাগ) উপহার দিতে চেয়েছিলেন।
আগা খান পুরস্কারের আগেও বেশ কটি পুরস্কার পেয়েছেন মেরিনা। নেক-১০ প্রজেক্টের জন্য ভারত থেকে পেয়েছেন ‘আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার’। সহপাঠী কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর সঙ্গে গড়া প্রতিষ্ঠান আরবানায় থাকাকালে পেয়েছেন ‘অনন্যা পুরস্কার ২০০৪’, একসঙ্গে নকশা করেছেন স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘর। সেই ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পর্যন্ত পুরো ইতিহাস যেন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এই জাদুঘরে। বহু প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা স্তম্ভ, হয়ে আছে বহুদূর থেকে দৃশ্যমান এক আলোকস্তম্ভ।
২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করেছে তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস’ বা এমটিএ। এর পাশাপাশি পড়াতে শুরু করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। একে একে বাড়তে থাকে তাঁর কাজ। কাজের পরিসরও। শূন্য থেকে শুরু করে এ বছর এক যুগ পূর্তি হলো এমটিএর।