বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা, যা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে একটি একক পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক কারণ আমাদের সামনে দণ্ডায়মান। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এটি যতটা না প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট, তার থেকেও বেশি মানবসৃষ্ট। মানবসৃষ্ট একাধিক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে প্লাস্টিক।
প্লাস্টিক হলো সিনথেটিক বা সেমি-সিনথেটিক ও নিম্ন গলনাঙ্কবিশিষ্ট পদার্থ, যা তাপীয় অবস্থায় যেকোনো আকার ধারণ করতে পারে এবং পুনরায় কঠিনে রূপান্তরিত হতে পারে। প্লাস্টিক স্থায়ী, সহজলভ্য, সস্তা এবং সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় আমরা সবাই প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল এমনকি উন্নত দেশেও প্লাস্টিক একটি নিত্য ব্যবহার্য বস্তু। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য প্লাস্টিক চাহিদা ব্যাপক। দিনের পর দিন প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।
প্লাস্টিক আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে যে আমরা উপলব্ধি করতে পারিনি প্লাস্টিক আমাদের এবং আমাদের পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যেসব প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যাদি ব্যবহার করি, সেগুলো তৈরি হয় তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। প্লাস্টিকের গামলা, বালতি, চায়ের কাপ, স্ট্র, পানির বোতল, জগ, কোমল পানীয়র পাত্র ইত্যাদি আরও অনেক ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিবছর মাথাপিছু প্রায় পাঁচ কেজি প্লাস্টিক দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে এর পরিমাণ ৩৪ কেজিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। আকার ও ওজনে সুবিধাজনক হলেও প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্লাস্টিকের পাত্রে কিছু রেখে খাওয়া ও প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করা ক্যানসারের কারণ হতে পারে। প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলেও ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান বের হয়ে খাবারের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। ফলে অ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যা হতে পারে। গত কয়েক শতাব্দীতে প্লাস্টিক থেকে তৈরি নানা দ্রব্য আমাদের জীবনযাপনের ধারাকে হয়তো বদলে দিয়েছে কিন্তু প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার শেষে আমাদের জন্য যে বিষাক্ত হয়ে উঠছে, তা অজানা নয়।
বছরে প্লাস্টিক উৎপাদনে ব্যবহার হয় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল
আমরা সবাই জানি যে গ্রিনহাউস প্রক্রিয়ার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যায়। গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড। এক আউন্স পরিমাণ প্লাস্টিক বা পলিথিন প্রস্তুত করলে পাঁচ আউন্স কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুতে নির্গত হয়। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতিবছর প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ব্যবহার করা হয়। এক কেজি প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় দুই থেকে তিন কেজি পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। সুতরাং একটি প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরি করতে প্রায় তার তিন গুণ কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুতে প্রবেশ করে, যা গ্রিনহাউস প্রক্রিয়ার গ্যাসগুলোর অনুপাতে প্রভাব বিস্তার করছে।
প্লাস্টিক দ্রব্য মানবস্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে আসছে। প্লাস্টিক বিভিন্ন উপায়ে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে যেমন পানির মাধ্যমে, মাছের মতো খাবার খাওয়ার ফলে বা প্লাস্টিক পণ্যগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে। প্লাস্টিক গ্রহণের ফলে মানবদেহে আলসার, জন্মগত ত্রুটি, জেনেটিক পরিবর্তন, দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কাইটিস, চর্মরোগ, বধিরতা, দৃষ্টি ব্যর্থতা, অচল ও লিভার সমস্যা এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। পিভিসি প্লাস্টিক পদার্থ (গৃহসজ্জার সামগ্রী, শিশুদের সুইমিংপুল, টাইলস, খেলনা, পানির পাইপ ইত্যাদি) দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে ক্যানসার, জন্মগত ত্রুটি, জেনেটিক পরিবর্তন ইত্যাদি হতে পারে। ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে, যা ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠীয় পানির সঙ্গে মিশে যায় এবং এভাবেই পানি গ্রহণে তা খাদ্যচক্রে ঢোকার মাধ্যমেও প্রতিনিয়ত মানবদেহে ক্ষতি সাধন করছে।
প্রাণিজগতের একটি বড় অংশ খাদ্যের জন্য পানিতে ভাসমান ক্ষুদ্র প্রাণিকণা এবং উদ্ভিদকণার ওপর নির্ভরশীল। গবেষণা অনুযায়ী, সমুদ্রে এক পাউন্ড প্ল্যাঙ্কটনের বিপরীতে ছয় পাউন্ড প্লাস্টিক বিদ্যমান। অনেক প্রজাতির মাছ, অ্যালজি বা শৈবাল খেয়ে জীবনধারণ করে। পানিতে পতিত হওয়া প্লাস্টিক অসম বাতাস এবং স্রোতের মাধ্যমে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। মাছেরা মাইক্রোপ্লাস্টিক ও শৈবালের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পেরে প্ল্যাঙ্কটন সাইজের মাইক্রোপ্লাস্টিককেই গ্রহণ করছে এবং সে মাছ গ্রহণ করার ফলে প্লাস্টিক পদার্থ মানবদেহেও প্রবেশ করতে পারে, যা খাদ্যশৃঙ্খলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক ছাড়াও পরিবেশে ন্যানো প্লাস্টিকও রয়েছে। কণা যত ছোট, সেগুলো পাচনতন্ত্রের মাধ্যমে টিস্যু বা তন্তুর মধ্যে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। প্লাস্টিক শুধু সামুদ্রিক মাছের ওপর নয় সামুদ্রিক পাখির ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। বেশির ভাগ সামুদ্রিক মাছের পেটে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক পাওয়া যায় কারণ সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক ও মাছের মধ্যে তুলনা না করতে পারায় পাখিরা প্লাস্টিককে নিজেদের খাদ্য মনে করে। ২০০৪ সালে এক গবেষণায় জানানো হয়, সামুদ্রিক গিল–এর পেটে ৩০ খণ্ডের সমপরিমাণ প্লাস্টিক পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে সামুদ্রিক অ্যালবাট্রোসের মতো পাখিদের অবস্থা সবচেয়ে ভয়ানক।
মানুষের ব্যবহার্য প্লাস্টিকের অধিকাংশের শেষ গন্তব্য সমুদ্র
প্রায় ৭ বিলিয়ন মানুষের ব্যবহার করা প্লাস্টিকের অধিকাংশেরই শেষ গন্তব্য হলো সমুদ্র। সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর প্লাস্টিকের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ২০১০ সালে সিটল সমুদ্রসৈকতে এক বিশাল তিমিকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানা যায় যে তিমির পাকস্থলীতে বহু প্লাস্টিক পদার্থ জমা হয়েছিল। সম্প্রতি ২০১৯ সালে, প্লাস্টিক ব্যাগ মুখে আটকে গিয়ে একটি সামুদ্রিক কচ্ছপের মৃত্যু হয়। প্রায় অর্ধেক সামুদ্রিক কচ্ছপ প্রতিবছর প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ গলাধঃকরণ করে যার ফলে অনেক প্রজাতিই মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, প্লাস্টিক দ্রব্য তাদের প্রজননেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০১৯ সালে একটি সিলের মৃত্যু হয় ৩৫ কেজি প্লাস্টিক পদার্থের সঙ্গে আটকে গিয়ে, যা মানবসমাজের জন্য খুবই হতাশাজনক।
প্রায় ১০ লাখ পরিযায়ী পাখি প্লাস্টিক দূষণের শিকার
বাংলাদেশে শীতকালে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো পরিযায়ী পাখি আসে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অবাধ বিচরণ ও প্রজননের জন্য এ সময় পাখি শিকার করা বন্ধ থাকে তবু দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর কারণ হতে পারে প্লাস্টিক। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ পরিযায়ী পাখি প্লাস্টিক দূষণের শিকার হচ্ছে। এসব পাখির প্রায় ৯০ শতাংশের পাকস্থলীতেই পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য। ২০১৯ সালের ‘বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবসে’ তুলে ধরা হয়েছে এ ভয়াবহ চিত্র। এসব পাখি সাধারণত সামুদ্রিক প্রাণীদের খেয়ে থাকে। সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের কারণে এসব পরিযায়ী পাখির পাকস্থলীতেও চলে যাচ্ছে প্লাস্টিক পদার্থগুলো।
প্লাস্টিক দ্রব্য ও প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। প্লাস্টিক পদার্থের বিয়োজন খুবই কষ্টসাধ্য। কিছু প্লাস্টিকের বিয়োজন হতে প্রায় হাজার বছরও লেগে যায়। প্রাকৃতিকভাবে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ৩০০ থেকে ৪০০ বছর লেগে যায়। এক গবেষণায় প্রমাণিত, মুদি দোকান থেকে কেনা পণ্য বহন করার জন্য যেসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। চা, কফি, জুস ইত্যাদি কোমল পানীয়র জন্য ব্যবহৃত প্লাস্টিক কাপ ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। ডায়াপার এবং প্লাস্টিক বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পচে না। যে জিনিসের বিয়োজিত হতে যত বেশি সময় লাগে, সে জিনিসটি পরিবেশের জন্য তত হুমকির কারণ। প্লাস্টিকের বিয়োজন অনেক সময়সাপেক্ষ, ফলে ব্যবহৃত প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যগুলো মাটির সঙ্গে না মিশে মাটিতেই থেকে যায়। লিথিফিকেশনের ফলে সেগুলোর ওপর আবার মাটি এসে পড়ে ফলে আপাতদৃষ্টিতে তা প্লাস্টিক মুক্ত মনে হলেও তার নিচে রয়েছে হাজারো প্লাস্টিক পদার্থ। এই প্লাস্টিকগুলো গাছপালাকে মাটি থেকে অক্সিজেন নিতে বাধা প্রদান করে ফলে অক্সিজেনের অভাবে গাছপালার বৃদ্ধি রহিত হয়, অনেক সময় অকালে মারা যায়। আবার প্লাস্টিকের স্তরের জন্য বৃষ্টির পানি মাটির ভেতরে পৌঁছাতে পারে না, যার ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যায় যা আমাদের সুপেয় পানির যোগানের ক্ষেত্রে অন্তরায়।
নদীমাতৃক আমাদের দেশের নদীগুলোর নাজেহাল অবস্থা। নদীদূষণের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম মূল ভূমিকা পালন করে প্লাস্টিক দ্রব্য। বিভিন্ন প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য নদীর নিচে গিয়ে জায়গা ধারণ করে। ফলে নদীর উচ্চতা হ্রাস পায় এবং নাব্যতা কমে যায়। ফলে আমরা আমাদের নদীগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছি।
প্লাস্টিক যে ক্ষতিকর, তা কারও অজানা নয়। তবে ক্ষতিকর জিনিসটাকেই সঠিক পদ্ধতিতে কাজে লাগাতে পারলে তা হয়ে উঠতে পারে একটি অভিন্ন সম্পদ, যা অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন বর্তমানে প্লাস্টিক থেকে তেল উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হচ্ছে, যা দেশের তেলের ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম হতে পারে।
প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকেই আমেরিকার বিভিন্ন শহরে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক বোতলজাত পানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের সরকার এই ক্ষতিকর দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশেও প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা প্রণয়ন করার জন্য কাজ চলছে। সাধারণ মানুষকেও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সরকার বা কোনো একক ব্যক্তির দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়। সবাই একযোগে এগিয়ে এলেই কঠিন কাজটি সহজ হয়ে যাবে। নিজের ঘর থেকেই এ কাজ শুরু হতে পারে। প্লাস্টিক পণ্য যতই ক্ষতিকারক হোক না কেন, তা একেবারে বন্ধ করা দুরূহ। আমরা প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে জৈব প্লাস্টিক ব্যবহারে উৎসাহী হতে পারি। আমাদের নিজেদের এবং সর্বোপরি পরিবেশের উন্নয়ন সাধনের জন্য প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনা একান্ত কাম্য।
*লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ