ধানসহ বিভিন্ন ফসল চাষে কৃষকের যে খরচ হয়, তার বড় অংশই আসে বেসরকারি ঋণ থেকে। এই ঋণের সুদও অনেক বেশি। আর সরকারি ঋণের সুদের হার কম হলেও কৃষক তা পান না বললেই চলে। আবার উৎপাদিত ধানের খুব সামান্যই কেনে সরকার। এর ফলে সুদে-আসলে সেই ঋণ শোধ করতে কৃষক কম দামে দ্রুত ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সম্প্রতি দেশের প্রধান ধান উৎপাদনকারী জেলা ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।
দেশে কৃষিঋণ পরিস্থিতির চিত্র খাদ্যনীতি পরামর্শবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) সমীক্ষায়ও উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক, দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে কৃষক ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ নেন। এসব ঋণের বড় অংশের সুদের হার ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ। আর সরকারের কৃষি ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে যে ঋণ দেয়, তা কৃষক খুব সামান্যই পান। কৃষকের মোট ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ আসে কৃষি ব্যাংক থেকে।
২০১৫ সালে করা ওই সমীক্ষার সুপারিশ গত ২০ মে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে উপস্থাপন করেছে ইফপ্রি। সংস্থাটি বলছে, কৃষিঋণ ও সুদের হারের পরিস্থিতি বর্তমানে প্রায় একই রকম আছে। কৃষককে লোকসান থেকে বাঁচাতে হলে কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
উচ্চ সুদে ঋণের ফলে দেশে ধানের উৎপাদন খরচও প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে অনেক বেশি। ভারতের কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশটিতে চলতি বছর এক কেজি ধানের উৎপাদন খরচ বাংলাদেশি টাকায় ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা। সরকার কিনছে ২০ টাকা ৮০ পয়সায়। প্রধান ধান উৎপাদনকারী অন্য দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামেও প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ ২০ টাকার কম। আর বাংলাদেশে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা। সরকার তা কিনছে ২৬ টাকায়।
এ বছর দেশে বোরোর রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে, প্রায় ২ কোটি টন। যদিও সরকার প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে কিনবে মাত্র দেড় লাখ টন। কৃষক সরকারের ঋণ যেমন কম পাচ্ছেন, তেমনি উৎপাদিত ধানের বেশির ভাগ সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রিও করতে পারছেন না। সম্প্রতি দেশের প্রধান ধান উৎপাদনকারী কয়েকটি জেলা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক এলাকায় কৃষি মজুরি দিনে ৭০০-৮০০ টাকায় পৌঁছেছে। চাষের আগে কৃষক যে ঋণ নিয়েছিলেন, তা শোধ করার জন্য তাঁদের ওপর চাপ বাড়ছে। ফলে কৃষক ১২ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কৃষকের ঋণের কিস্তি ও সুদের হার শিথিল করেনি। ফলে এবারের বোরো মৌসুমে বেশির ভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষির যথাসময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, কৃষি ব্যাংকের সুদের হার অন্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কম। কিন্তু এই ব্যাংকের ঋণ দেশের কৃষকদের বড় অংশ পায় না। কারণ একদম গ্রামীণ পর্যায়ে এই ব্যাংকের শাখা নেই। কিন্তু এনজিওদের শাখা আছে। ফসলের উৎপাদন খরচ কমাতে গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষি ব্যাংকের আরও শাখা খুলতে হবে। কৃষি ব্যাংকের তহবিলও বাড়াতে হবে।
৬ শতাংশ ঋণ আসে কৃষি ব্যাংক থেকে
ইফপ্রির সমীক্ষায় দেখা গেছে, কৃষকেরা কৃষিকাজের জন্য যে ঋণ নেন, তার সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে এনজিও। সেখান থেকে আসে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ ঋণ। এরপরই তাঁরা ঋণ নেন আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে। মূলত প্রবাসী ও সচ্ছল আত্মীয়দের কাছ থেকে আসা ওই ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৯ শতাংশ। জমির মালিকের কাছ থেকেও অগ্রিম টাকা ঋণ হিসেবে নেন কৃষক। এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৫ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলের অনানুষ্ঠানিক সুদের কারবারি বা দাদন ১১ দশমিক ৪ শতাংশ ও সমিতিগুলো থেকে আসে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণ।
অন্যদিকে সরকারের কৃষি ব্যাংক থেকে আসা ঋণের পরিমাণ ৬ শতাংশের মতো। এই ঋণের সবচেয়ে বেশি অংশ পান বড় চাষিরা, প্রায় ১৫ শতাংশ। বড়, মাঝারি ও ছোট চাষি মিলে মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ পান। আর প্রান্তিক চাষি পান ৫ শতাংশের মতো। বর্গাচাষি অর্থাৎ অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষ করেন এমন কৃষকেরা এই ঋণ পান না। ফলে তাঁদের এনজিওসহ অন্য উৎসের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়।
এ বিষয়ে কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রতিবছর ৩ লাখ ৩৫ হাজার কৃষককে ৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা কৃষিঋণ দিয়ে থাকি। এ বছর নতুন করে ১ লাখ ৬৫ হাজার কৃষককে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছি। ধারাবাহিকভাবে কৃষিঋণের পরিমাণ ও আওতা বাড়াব।’
কে কত সুদ নেয়
ইফপ্রির সমীক্ষায় কোন উৎসের ঋণ নিয়ে কৃষক কত সুদ দেন, তার হিসাবও বের করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি সুদ নেন দাদন বা সুদের কারবারিরা। তাঁরা ৬৩ শতাংশ হারে সুদ নেন। মূলত জরুরি কৃষি উপকরণ যেমন সার, কীটনাশক ও সেচের খরচ জোগাতে কৃষক এসব ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ নেন। কোনো জামানত ছাড়া শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা পরিচয়ের ভিত্তিতে এসব ঋণ দেওয়া হয় বলে অনেক কৃষক এখনো এভাবে ঋণ নেন।
ঋণের সুদের হারের ক্ষেত্রে দাদনের পরই রয়েছে এনজিও। এই খাত থেকে বছরে সোয়া লাখ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয় বাংলাদেশ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সদস্য এনজিওগুলো। তারা সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ হারে সুদ নিয়ে থাকে। মূলত বিভিন্ন ফসলের মৌসুমে তিন থেকে পাঁচ মাস সময়ের জন্য এসব ঋণ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকের যাতে লোকসান না হয় সে জন্য উৎপাদন খরচ কমানোটা জরুরি। পিকেএসএফের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, তাঁরা ধারাবাহিকভাবে কৃষিঋণের সুদের হার কমাচ্ছেন। দ্রুত ও কার্যকরভাবে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কৃষককে কারিগরি সহযোগিতাও দিচ্ছেন।
দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের গ্রামীণ ঋণের একটি অংশ কৃষিঋণ হিসেবে বিতরণ করে। তাদের গড় সুদের হার ১৩ শতাংশের বেশি। এর বাইরে বিভিন্ন সমিতি থেকে নেওয়া ঋণের সুদের হার গড়ে ১৯ শতাংশ। মূলত বিভিন্ন সমবায় সমিতি এই ঋণগুলো দিয়ে থাকে। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণে সুদের হার ৮ শতাংশ।
কৃষিঋণের এই চিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে ইফপ্রি বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক আখতার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকেরা সাধারণত এসব ঋণ নিয়ে কৃষি উপকরণ কিনে থাকেন। তাঁরা স্বল্প সুদে ও সহজে এসব ঋণ পেলে তাঁদের উৎপাদন খরচ অনেক কমে যেত। ফলে প্রতিবছর কৃষক ধানে ও সবজিতে যে লোকসান দিচ্ছেন, সেটা হতো না। কৃষিঋণের সুদের হার কমিয়ে তা কৃষকের জন্য সহজলভ্য করা না গেলে লোকসান কমানো যাবে না।