মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে সরকারকে রক্ষায় ও তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে। এ আইনের কারণে শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আজ সোমবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮: রাজনীতিবিদদের চোখে’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এসব কথা উঠে আসে।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বিরোধী মতকে দমন করার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। দেশে অনেক দৃশ্যমান উন্নয়ন হলেও গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা, আইনের শাসনের মতো অদৃশ্য উন্নয়ন নেই। এ আইন প্রণয়নের পর থেকে মানুষ এখন গণমাধ্যমে মন খুলে বলতে পারছেন না, লিখতে পারছেন না। এ আইনকে অতিদ্রুত সংশোধন করতে হবে।
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, দেশের প্রচলিত আইনে সংশোধন এনে বিচার করা যায়। ভিন্ন কোনো আইন দরকার ছিল না।
সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার জন্য এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র আছে, চিন্তার স্বাধীনতা আছে, বাক্স্বাধীনতা আছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও আছে। পৃথিবীর সব দেশই তাদের নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়ে থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মধ্যে যদি কোনো অসামঞ্জস্যতা থেকে থাকে, সেটি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান আহমদ হোসেন। তিনি আরও বলেন, জনগণের নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োজন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আইনটির অপপ্রয়োগের পাশাপাশি অসম প্রয়োগ হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তার জন্য আইন দরকার কিন্তু মানুষকে শৃঙ্খলে বন্দী করার জন্য নয়। তিনি আরও বলেন, এ আইনের পর মানুষ মামলা করেন ব্যক্তিগত অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে, যা অন্য ব্যক্তিকে হয়রানি করার একটি প্রক্রিয়া।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে এ আইনের আওতায় মামলা হয়, কিন্তু আইনে সেই চেতনার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাই দেওয়া হয়নি বলে জানান আবদুল আউয়াল।
সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইনগুলো পর্যালোচনা করার জন্য সাংদদের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে শুধু রাষ্ট্র কেবল একজনের ওপর অত্যাচার করে না; বরং ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের ওপর অত্যাচার চালায়। এ আইন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ‘সস্তা আইন’ বলে উল্লেখ করে বলেন, শুধু ভয়ভীতি দেখানোর জন্য এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সাংবাদিক এবং বিরোধী দলকে ঠেকানোর জন্য এ আইন। যেখানে আইন প্রণয়ন করা হয় জনগণকে রক্ষা করার জন্য, সেখানে এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে সরকারকে রক্ষা করার জন্য এবং মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। সরকার ক্ষমতা হারানোর ভয়ে থাকে বলেই জনগণের মুখ বন্ধ রাখার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে। আইনটি বাতিল এখন সময়ের দাবি বলেও জানান তিনি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুলিশের হাতে একচেটিয়া ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইনটির কিছু ধারা বাক্স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণার বিপরীত। তিনি আরও বলেন, লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু একটি রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড এবং মুশতাক আহমেদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রথম শহীদ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত করার জন্য এ আইন বাতিল করা প্রয়োজন বলে জানান।
ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
সভাপতির বক্তব্যে সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, কার্টুনিস্ট কিশোর এবং লেখক মুশতাকের ঘটনা মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশের মতো আধুনিক রাষ্ট্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকতে পারে না।