দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান বলেছেন, জনগণকে হয়রানি করার অধিকার কারও নেই। দুর্নীতি এবং দীর্ঘসূত্রতা মুক্ত থেকে সরকারি পরিষেবা দেওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের আইনি দায়িত্ব। সেবা দিতে গিয়ে কেউ ঘুষ দাবি করলে, দুদকের অভিযোগ কেন্দ্রের হটলাইন--১০৬ এ অভিযোগ জানানোর আহ্বান জানিয়ে দুদক কমিশনার বলেন, অভিযোগ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারসহ সব রকম আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না।
আজ বৃহস্পতিবার কেরানীগঞ্জের উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ‘রুখব দুর্নীতি গড়ব দেশ, হবে সোনার বাংলাদেশ’ এ প্রতিপাদ্য নিয়ে দুদকের গণশুনানিতে তিনি এসব কথা বলেন। গণশুনানিতে উপজেলা ভূমি অফিস ও সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়, বিআরটিএ, উপজেলা সমাজসেবা অফিস, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৪, তিতাস গ্যাস, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, প্রাথমিক শিক্ষা, উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের সেবা নিয়ে নানা অভিযোগ উঠে আসে।
গণশুনানিতে স্থানীয় সেবাপ্রত্যাশী নাগরিকেরা ভূমি, পল্লী বিদ্যুৎ, বিআরটিএসহ অন্যান্য দপ্তরসংশ্লিষ্ট মোট ২৭টি অভিযোগ উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে ১০টি অভিযোগ দুদক কমিশনারের নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে নিষ্পত্তি করা হয়। পল্লী বিদ্যুৎ–সংক্রান্ত একটি অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন দুদক কমিশনার।
শুনানিতে কেরানীগঞ্জ উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি বেদৌরা আলী বলেন, উপজেলার মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাইভেট কোচিং পড়ানো হচ্ছে। এসব কোচিং বন্ধ করা দরকার।
শেখ শাহ সৈয়দ নামের এক ব্যক্তি বলেন, কেরানীগঞ্জের সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ে জমির দলিল করতে গেলে ৫ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া সাবরেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তাদের দাবি মোতাবেক আরও ১ হাজার ২০০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়। দলিল লেখকদের মাধ্যমে এসব অনৈতিক কাজ ও ঘুষের টাকা লেনদেন হয়ে থাকে। ভূমি কার্যালয়ে এসব দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করা দরকার।
কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া এলাকার বাসিন্দা ইমদাদ হোসেন বিদ্যুৎ বিভাগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, বৈদ্যুতিক সংযোগ নিতে হলে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা বাড়তি খরচ করতে হয়। তা না হলে বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়া যায় না।
নুরন্ডী এলাকার বাসিন্দা মো. আইনুদ্দিন অভিযোগ করেন, ‘আমি নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করার পরও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কার্যালয় থেকে ডেসার মাইনুদ্দিন নামের এক ব্যক্তি ১৯ হাজার ৫০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল চাপিয়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে একাধিকবার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।’
এ অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৪–এর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্রাহকদের অভিযোগগুলোর বিষয়ে আগামী ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ সময় দুদক কমিশনার বলেন, এখানে অনিয়ম হয়েছে। গ্রাহকদের হয়রানি করা যাবে না। এভাবে চলতে থাকলে দুদক হস্তক্ষেপ করবে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
স্থানীয় সাংবাদিক আবু জাফর বিআরটিএর দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার পরিচিত রিগেন মণ্ডল গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য শিক্ষানবিশ লাইসেন্স সংগ্রহ করেন। সেখানে এ বছর ১৯ নভেম্বর ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষার জন্য তারিখ দেওয়া হয়েছে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা দিতে যদি ১৪ মাস অপেক্ষা করতে হয়, তবে সনদ পেতে প্রায় দেড় বছর পর সময় লাগলে তাঁর কর্মজীবনের সেই ড্রাইভিং লাইসেন্স কোনো কাজে আসবে না। তাই ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার সময় আরও কমানো দরকার।’
দুদক কমিশনার বলেন, জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তোলার জন্য গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আজ গণশুনানিতে অভিযোগগুলো ত্রুটিপূর্ণ ছিল এবং সুনির্দিষ্ট ছিল না। কে কাকে কবে কত টাকা দিয়েছেন সেটা সুস্পষ্ট ছিল না।
কমিশনার আরও বলেন, আগে দুর্নীতির অভিযোগ পেলে প্রতিকার হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হতো। কিন্তু এখন প্রতিকারের পাশাপাশি দুর্নীতি কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, সে বিষয়েও কাজ করছে দুদক।
মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুদক দুর্নীতি প্রতিরোধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি অবলম্বন করেছে। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সব রকম হস্তক্ষেপের ঊর্ধ্বে থেকে সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন করছে। দুদক এখন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের কাছে ভীতিকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
মোজাম্মেল হক খান বলেন, গণশুনানি মূল উদ্দেশ্য জনগণের সরকারি সেবা প্রাপ্তির সব প্রতিবন্ধকতা দূর করা। স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের কল্যাণমূলক কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির একটি অন্যতম কৌশল হচ্ছে গণশুনানি। জনগণ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মিথস্ক্রিয়ার একটি নতুন ধারা। একে সরকারি সেবাপ্রত্যাশী জনগণ এবং সেবা প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংযোগের একটি প্রক্রিয়াও বলা যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে দুটি কারণে দুর্নীতি হচ্ছে। প্রথমত পেটের দায়ে, দ্বিতীয়ত বিলাসিতার জন্য। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত দুর্নীতি হচ্ছে। এসব দুর্নীতি বন্ধ করলেই দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে।’
ঢাকা জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খানের সভাপতিত্বে গণশুনানিতে বক্তব্য দেন কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহে এলিদ মাইনুল আমীন, দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. আক্তার হোসেন প্রমুখ।