সরকার প্রতিবছর যে চাল সংগ্রহ করে, তাতে মূলত চালকলমালিকেরা লাভবান হন। গত বছর চালকল মালিকেরা সরকারি গুদামে যে চাল সরবরাহ করেছেন, তার ৯৪ শতাংশ ছিল হাইব্রিড চাল। বাজারের অন্য মোটা চালের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম দামে, ১৪ টাকা কেজি দরে কেনেন। নিজেদের মিলে ওই ধান চালে পরিণত করে ৩৬ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এসব চাল অপেক্ষাকৃত মোটা ও নিম্নমানের।
খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফপ্রি থেকে দেশে বোরো উৎপাদন, সংগ্রহ, বিক্রি ও বাজার নিয়ে করা এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহায়তায় গবেষণাটি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইফপ্রির প্রতিবেদনটি আমি পড়েছি। তাদের পরামর্শগুলো আমলে নিয়ে আমরা কাজ করব। তবে আমরা গত বছর প্রায় চার লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সংগ্রহ করেছি। এবার আট লাখ টন সংগ্রহ করা হবে। সামনের বছর তা আরও বাড়ানো হবে।’
কী করলে সরকারি সংগ্রহ থেকে কৃষক লাভবান হবেন, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে গবেষণাটিতে। বলা হয়েছে, সরকার যদি খাদ্য সংগ্রহের পুরোটা ধান হিসেবে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কিনে নেয়, তাহলে তা কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য ভালো হবে। সরকার গত বছর যখন প্রায় চার লাখ টন ধান কেনে, তখন ধানের দাম প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ বেড়ে যায়। আর যদি সংগ্রহের পুরোটা ধান হিসেবে কিনত, তাহলে দাম বাড়ত ৪৫ শতাংশ।
আর সরকার যদি সরাসরি ধান কেনে, তাহলে গুদামে শুধু হাইব্রিড ধান আসবে না। সব ধরনের ধান সরকারি গুদামে কৃষক বিক্রি করবেন। এতে সরকারি চালের যে ভোক্তা, অর্থাৎ দরিদ্র মানুষ কিছুটা উন্নত মানের চাল পাবেন।
>ইফপ্রির গবেষণা: খাদ্য সংগ্রহের পুরোটা ধান হিসেবে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কিনলে কৃষক লাভবান হবেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইফপ্রি বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আখতার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি গুদামগুলোতে কৃষক ধান বিক্রি করতে গেলে একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ধানের আর্দ্রতা নিয়ে। কৃষকদের বড় অংশ সাধারণত ভেজা ধান বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। কিন্তু সরকার ১৪ শতাংশের বেশি আর্দ্রতা থাকলে তা কিনতে চায় না। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে আর্দ্রতা অনুযায়ী ধানের দাম ঠিক করা যেতে পারে।
গবেষণাটিতে পরামর্শ হিসেবে বলা হয়েছে, সরকার চালকলগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ধান সেখানে ভাঙাতে পারে। দেশের বেশির ভাগ বড় চালকলে ধান শুকানোর আধুনিক ব্যবস্থা আছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ওই ধানের আর্দ্রতা বেশি হলে চালকল-মালিক দ্রুত তা সরকারি গুদাম থেকে নিয়ে যাবে। আর আর্দ্রতা কম থাকলে সরকার তা গুদামে রেখে দিয়ে সুবিধামতো সময়ে ভাঙানোর ব্যবস্থা করবে।
গত বছর বাংলাদেশে ৩ কোটি ৬৩ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে সরকার সংগ্রহ করেছে ১৪ লাখ ১৮ হাজার টন। ওই সংগ্রহের ৮১ শতাংশ সরবরাহ করেছেন চালকলমালিকেরা। বাকি ১৯ শতাংশ সংগ্রহ করা হয়েছে কৃষকের কাছ থেকে ধান হিসেবে।
দেশের চালকলমালিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব চালকলমালিক ১৪ টাকায় ধান কিনে তা চালে পরিণত করে ৩৬ টাকায় সরকারি গুদামে বিক্রি করেছেন। এই তথ্য আমি পুরোপুরি অস্বীকার করব না। কোনো কোনো চালকল তা করতে পারে। তবে বেশির ভাগ চালকল এত লাভ করার সুযোগ পায়নি।’ আর সরকারি গুদামে হাইব্রিড চাল সরবরাহের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সরকার নিজেই মোটা চাল কিনতে চায় এবং সে অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করে। ফলে আমরা সে ধরনের চালই সরকারি গুদামে বিক্রি করি।’
কার ক্ষতি, কার কত লাভ
ইফপ্রির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বোরো ধানের ৪৭ শতাংশ উৎপাদন করেন ক্ষুদ্র চাষিরা। ৩৩ শতাংশ চাষি নগদ টাকায় জমি ভাড়া নিয়ে চাষ করেন, আর ২৬ শতাংশ হচ্ছেন ভাগচাষি। ধানের দাম কম হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এই তিন ধরনের চাষিরা। তাঁরা মূলত ঋণ করে ও পারিবারিক অর্থ বিনিয়োগ করে ধান চাষ করেন। এরপর উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ধান বেচে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
পরামর্শ হিসেবে বলা হয়েছে, সরকার চলতি বছর যে পরিমাণ ধান ও চাল সংগ্রহ করবে, তা যদি শুধু ধান হিসেবে সংগ্রহ করে, তাহলে ৩১ লাখ টন ধান সংগ্রহ করতে হবে। সরকারি হিসাবে ১০০ কেজি ধান ভাঙালে ৬৮ কেজি চাল হয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকের কাছ থেকে ধান সরাসরি কিনতে পারলে সেটা খুবই ভালো কাজ হবে। তাহলে কৃষক দাম পাবেন। কিন্তু তার আগে এত ধান, এত কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনার মতো অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।