সরকারকে বিপদে ফেলতেই আলেম হত্যার প্রচারণা

গত ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রাতের অভিযানে কেউ নিহত হননি। সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য হাজার হাজার আলেম হত্যার প্রচারণা চালানো হয়েছে। তবে ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৫ মে দিনের বেলা ও পরদিনের সংঘাতে মোট ৩৯ জন নিহত হয়েছেন। ‘হেফাজত-জামায়াতের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ৪০০ দিন’ নামের একটি শ্বেতপত্রে এই দাবি করা হয়েছে। শ্বেতপত্রটি তৈরি করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। গতকাল শুক্রবার শ্বেতপত্রের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সেদিনের সমাবেশ আহ্বানকারী হেফাজতে ইসলামের মাওলানা শাহ আহমদ শফী ও সেই সমাবেশ সমর্থনকারী বিরোধীদলীয় নেতাকে হুকুমের আসামি করার প্রস্তাব দিয়ে তাঁদের বিচারের দাবি করা হয়।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, সেদিনের সমাবেশ করতে দিয়ে সরকার ভুল করেছে, তাই এর দায় সরকারকেও নিতে হবে। নিহত ব্যক্তিদের প্রতিটি পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে দেওয়া এবং তাঁদের সন্তানদের যথাযোগ্য শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়। ‘৫ মের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কীভাবে বিপন্ন হয়েছিল, সেদিন আসলে কতজন নিহত হয়েছিল, হেফাজত-জামায়াতের আসল পরিচয় কী, তারা কী চায়’—এসব বিষয় তদন্ত করে এই শ্বেতপত্রটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্মূল কমিটি। গতকাল বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে শ্বেতপত্রটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, এই শ্বেতপত্র তৈরির জন্য নির্মূল কমিটির উদ্যোগে বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। পাঁচ মাস ধরে মাঠপর্যায়ে তদন্ত ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কমিশন শ্বেতপত্রটি তৈরি করে। ওই সমাবেশের পর হাজার হাজার আলেম হত্যার যে প্রচারণা চালানো হয়, এর পরিপ্রেক্ষিতেই এই শ্বেতপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। কমিশনের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাংবাদিক কামাল লোহানী, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক অজয় রায়, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শিক্ষাবিদ শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী প্রমুখ।

গতকালের অনুষ্ঠানে এক হাজার ২৫০ পৃষ্ঠার এই শ্বেতপত্রের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে কমিশনের সদস্যসচিব শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘গত ৬ আগস্ট হেফাজতের পক্ষ থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে আমাদের কাছে পাঁচ পৃষ্ঠার তালিকা পাঠানো হয়। সেখানে ৭৯ জন “শাহাদাতবরণকারী”র নাম পাঠানো হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি কথিত নিহত ব্যক্তির ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করে কমিশন। তদন্তকাজে নিহত ব্যক্তিদের পরিবার, কবরস্থান এবং দেশের এক হাজার মাদ্রাসায় যায় তদন্ত দল। প্রকৃত নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৩৯।’ শাহরিয়ার কবির দাবি করেন, ৫ মে রাতের অভিযানে কেউ নিহত হননি। হেফাজত এবং মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ উভয় তালিকা অতিরঞ্জিত, অসম্পূর্ণ। হেফাজতের তালিকায় একই নাম দুই বা তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে।

তালিকাটি তৈরি করতে হেফাজত এবং জামায়াতের কিছু কর্মীর সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে বলে শাহরিয়ার কবিরের দাবি। তিনি বলেন, নির্মূল কমিটির তৈরি যে তালিকা, এর চেয়ে প্রামাণ্য তালিকা কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সেদিনের অভিযানে হাজার হাজার আলেম হত্যার যে প্রচারণা চালানো হয়েছে তা মিথ্যা। সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য এবং আলেম হত্যার খবর রটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে অর্থ আদায়ের জন্যই এটা করা হয়েছে। সেদিনের সমাবেশের মাধ্যমে মূলত সরকার উত্খাতের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।

হেফাজতের নেতাদের মধ্যে কারা চেচনিয়া, আফগানিস্তান বা পাকিস্তানে জঙ্গিবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন সেই তালিকাও শ্বেতপত্রে দেওয়া হয়েছে বলে জানান শাহরিয়ার কবির। শ্বেতপত্রের মোড়ক উন্মোচন করে নির্মূল কমিটির সভাপতি বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, সংবিধানে আছে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এরা অসাংবিধানিক জনগণ। এই অসাংবিধানিক জনগণকে নির্মূল না করা গেলে বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।

তদন্ত কমিশনের প্রধান সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, জামায়াত-হেফাজত-বিএনপি এই শক্তির সঙ্গে আপসের কোনো সুযোগ নেই। আসন্ন নির্বাচনে এই শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে হেফাজতের সমাবেশের আগে ও পরে নিহত হওয়া চার ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শাহজাহান নামে একজন দাবি করেন, তাঁর ভাই হেফাজতে ইসলামের কর্মী মুহাম্মদ আবদুল হান্নান নিহত হওয়ার পর হেফাজতের পক্ষ থেকে কেউ তাঁদের সাহায্য করেননি। নিহত হওয়া ব্যক্তিদের চার পরিবারকে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়।