বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়া হলে এখন এভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হতো না বলে মনে করেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বে-নজির আহমেদ।
তাঁর মতে, গত বছর মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে।
আজ রোববার ‘করোনা মহামারি ও করণীয়’ শিরোনামে এক ওয়েবিনারে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়ে অভিমত দেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বাম গণতান্ত্রিক জোট এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে–নজির আহমেদ বলেন, গত বছর দীর্ঘদিন লকডাউন ছিল দেশে। তবু করোনার সংক্রমণ কমানো যায়নি। মানুষ অনেক ক্ষতির শিকার হয়েছে, কিন্তু লাভবান হয়নি।
তিনি বলেন, ‘গেল এক বছরে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সামান্য উন্নতি হয়নি, বরং কমেছে। আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন প্রথম দিকে যতটা মানা হচ্ছিল, এখন তা মানা হচ্ছে না। পরিস্থিতি যেমন চলছে তাতে করোনার সংক্রমণ আবার বাড়ার সম্ভাবনা আছে। সময়মতো উদ্যোগ নেওয়া হলে এত দিন এত কিছু বন্ধ রাখতে হতো না।’
বাংলাদেশে গত বছর ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সে সময় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে টানা ৬৬ দিন দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এর পরের কয়েক মাসে সংক্রমণ কমে এলেও গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যু বাড়তে থাকে। সংক্রমণে লাগাম টানতে গত ৫ এপ্রিল থেকে দেশে বিধিনিষেধ চলছে, যা ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বহাল থাকবে।
আলোচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, জনস্বাস্থ্যবিদেরা বিভিন্ন সময়ে সরকারকে উপদেশ দিয়েছেন। তারা কোনো সময় এগুলো নেয়, কোনো সময়ে নেয় না।
বাংলাদেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি নন মেডিকেল লকডাউন, যেখানে মানুষের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করাই মুখ্য। এটাকে বিজ্ঞানভিত্তিক করার উপাদানের অভাব ছিল। মাস্ক পরা করোনার সব ধরনের বিরুদ্ধেই কাজ করে। তাই মাস্ক পরা আরও বাড়াতে হবে। এর জন্য জনগণের সচেতনতাই কাম্য।’
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুবের মতে, করোনাভাইরাস দ্রুত রূপান্তরিত হচ্ছে। সে কারণে এ নিয়ে আরও গবেষণা করা দরকার।
তিনি বলেন, ‘জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শ সরকার কিছু মানে, আবার কিছু মানে না। তাই সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে না এবং করোনা থেকেও দ্রুত মুক্তি নেই।’
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যখন ঘরের বাইরে বের হতে বারণ করা হচ্ছে, তখন দরিদ্রদের জন্য কী করা হচ্ছে, তা দেখা দরকার বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব।
তিনি বলেন, জীবনকে বাঁচাতে হবে, জীবিকাও দেখতে হবে। যাদের সাহায্য দরকার, সরকারকে তা দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি দিয়ে করোনা মোকাবিলা করতে হবে।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়া নিয়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, তাকে ‘বিশ্ব রাজনীতির অংশ’ হিসেবে দেখছেন অধ্যাপক রশীদ–ই–মাহবুব। বাংলাদেশের আগে থেকেই বিকল্প ভাবা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চিকিৎসক লেনিন চৌধুরী বলেন, দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে, যা আগের চেয়ে ভয়াবহ। সংক্রমণ, মৃত্যু বেড়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ কার্যাবলির প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে ‘সামগ্রিক কোনো পরিকল্পনা নেই’। প্রতিরোধের জায়গা ঠিক করা হয়নি।
তিনি বলেন, মানুষ মাস্ক পরতে চায় না। তাদের মাস্ক পরতে উৎসাহিত করতে হবে। কিন্তু লাঠির ভয় দেখিয়ে মানুষকে মাস্ক পরাতে বাধ্য করা যায় না। জনসম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো লকডাউন সফল হয় না।
আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘করোনাকালে চিকিৎসকেরা সম্মুখযোদ্ধা হয়ে কাজ করছেন। অথচ করোনায় মারা যাওয়া কেবল একজন চিকিৎসকের পরিবার টাকা পেয়েছেন। বাকিরা কিছুই পাননি। সম্মুখযোদ্ধাদের ঝুঁকি ভাতা দেওয়া হচ্ছে না।
গার্মেন্ট কারখানার মালিকেরা হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা পাচ্ছেন। তবে শ্রমিকদের কাছে সে টাকা পৌঁছাচ্ছে না। সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ববোধ কি নেই?’
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সভার সভাপতি বজলুর রশীদ ফিরোজ। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আগেও ভঙ্গুর ছিল, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। করোনায় তা পুরো উন্মোচিত হয়েছে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য লিয়াকত আলী বলেন, লকডাউন হচ্ছে করোনা সংক্রমণ কমানোর একটি ব্যবস্থা। তবে ‘ম্যাজিক বুলেট’ নয়। লকডাউনে ভুক্তভোগীদের জন্য রাষ্ট্রের ব্যবস্থা না থাকলে লকডাউন সফল হয় না। এটি সফল করতে জনসম্পৃক্ততা লাগবেই।
তিনি বলেন, প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে জনসম্পৃক্ততা লাগবে। লকডাউনের সময়ে এটি করা না গেলে লকডাউনের ভুক্তভোগীদের ভোগান্তি আরও হবে।
ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাকিবুল ইসলাম বলেন, করোনা মোকাবিলা বিচ্ছিন্নভাবে নিলে হবে না। এর জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
ওয়েবিনারে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন প্রমুখ।