রাজধানীর কাকরাইলের ‘ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারের’ চতুর্থ তলাটি যুবলীগের অফিস করার জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। ভাড়া দেওয়া তো দূরের কথা, ভবনটির বাকি সব তলাও তিনি দখল করে নেন। ৯ বছর পর গত ২২ সেপ্টেম্বর ভবনটির দখল ফিরে পান দুই মালিক। র্যাবের পক্ষ থেকে ৯তলা ভবনটি মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
গত বছরের ৬ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাট ও তাঁর সংগঠনের সহসভাপতি এনামুল হককে (আরমান) কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে অস্ত্র, মাদকসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। গ্রেপ্তারের পর থেকে তাঁরা কারাগারে আছেন। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে সম্রাটের ছয় মাসের সাজা হয়েছে।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, অভিযানে সময় সম্রাটের দখলে থাকা ৯তলা ভবন ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার নিরাপত্তার স্বার্থে সিলগালা করে রাখা হয়েছিল। এখন ভবনটির চারতলা ছাড়া বাকি সব তলা মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে চতুর্থ তলাটি এখনো সিলগালা অবস্থায় থাকবে।
ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারের মালিক দবির উদ্দিন ভূঁইয়া ও আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, এত বছর এই ভবন থেকে তাঁরা কোনো ভাড়া পাননি। ভয়ে ভাড়া চাইতেও পারেননি।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটির বিভিন্ন তলায় আবর্জনা ও ভাঙা মালামালের স্তূপ। এর লিফটগুলোও অচল।
নির্মাণ সূত্রে ভবনের একটি অংশের মালিক আবু সাঈদ। ওই দিন ভবনটির নিচতলায় পাওয়া গেল তাঁকে। আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, এত বছরে সম্রাট এই ভবনের ধারেকাছে তাঁকে ভিড়তে দেননি। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় তাঁরা দখল পাচ্ছেন।
দবিরউদ্দিন ভূঁইয়া মুঠোফোনে বলেন, ৯তলার ছাদে সম্রাট বাগানবাড়ি বানিয়েছিলেন। এখানে নাচগানের আসর বসাতেন।
তিনজন জামিনে মুক্ত
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা ক্যাসিনোবিরোধী ও বিশেষ অভিযানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ১৫ জন গ্রেপ্তার হন। তাঁদের মধ্যে তিনজন এরই মধ্যে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। সর্বশেষ জামিন পান ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য আইনের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এর আগে জামিনে বের হন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের নেতা শফিকুল আলম (ফিরোজ)। কয়েক মাস ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কারা হেফাজতে চিকিৎসাধীন আছেন সম্রাট ও প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম।
ক্লাবগুলোতে এখনো তালা
ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, মতিঝিলের দিলকুশা ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও কলাবাগান ক্লাবে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ ও র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর সেখানে গেলে সব ক্লাবে তালা ঝুলতে দেখা যায়। ইয়ংমেনস ক্লাবের ফটকের বাইরে থেকে দেখা যায়, ভেতরে ময়লা জমে আছে। সেখানে কিছু যুবক ত্রিপল টানিয়ে ক্যারম খেলছেন।
এদের একজন রহমতউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আগে ক্যাসিনো খেলতে আসা মানুষের ভিড় লেগে থাকত গলিতে। এখন সব ফাঁকা পড়ে থাকে।
ইয়ংমেনস ক্লাবের কাছেই ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। ক্লাবটির কলাপসিবল ফটকে তালা। ফটকজুড়ে চটপটির ভ্যান রাখা। পাশে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি ঝিমুচ্ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮ সালের দিকে এই ক্লাবে ক্যাসিনো শুরু হয়। ক্যাসিনো খেলতে আসা লোকেরা রেস্তোরাঁয় খেতেন। তিনি সেই রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন। ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবাই পথে বসেছেন।
৩৫ মামলার তদন্ত শেষ হচ্ছে না
ক্যাসিনো–কাণ্ড ও বিশেষ অভিযানে ধরা পড়া ১৫ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, বিশেষ ক্ষমতা আইন, মানি লন্ডারিং ও দুদক আইনে হওয়া ৩৫ মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। এর বাইরে ২৩ মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ ও র্যাব।
এ অভিযানে ১৫ জন গ্রেপ্তার হন। তাঁদের বিরুদ্ধে ৫৮টি মামলা করে র্যাব, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। এর মধ্যে র্যাব-সিআইডি মিলে অস্ত্র, মাদক, বিশেষ ক্ষমতা ও মানি লন্ডারিং আইনে ৩৭টি মামলা করে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের খোঁজ পেয়ে গ্রেপ্তার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক ছাড়া বাকি ১৪ জনের বিরুদ্ধে ২১টি মামলা করে দুদক।
আদালতে জমা পড়া ২৩ মামলার অভিযোগপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, আদালত অভিযোগপত্রগুলো গ্রহণ করেছেন। এখন তা সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠানোর পর বিচারকাজ শুরু হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাসিনো–কাণ্ডে হওয়া র্যাব ১৪ মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায়। ইতিমধ্যে সেগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বিশেষ অভিযানে ধরা পড়া শামীমা নুর পাপিয়ার বিরুদ্ধে হওয়া দুই মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
ধরা পড়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে ১৪টি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ সুপার মো. মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, মানি লন্ডারিং আইনে হওয়া ৯ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি পাঁচ মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
দুদক সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার ১৪ জনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২১টি মামলা করেছে দুদক।
যোগাযোগ করা হলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, দুদকের মামলাগুলোর তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
আদালতে জমা পড়া ২৩ মামলার অভিযোগপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, আদালত অভিযোগপত্রগুলো গ্রহণ করেছেন। এখন তা সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠানোর পর বিচারকাজ শুরু হবে।