প্রায় প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কোনো না কোনো শিক্ষকের অবদান রয়েছে। তবে প্রিয় শিক্ষকের কথা উঠলেই বেশির ভাগ মানুষ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কোনো না কোনো শিক্ষকের কথা বলেন। সেই সব প্রিয় শিক্ষককে সম্মাননা দেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি ও প্রথম আলো।
নির্ধারিত নিয়মে মনোনয়ন শেষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০ জন শিক্ষককে দেওয়া হবে ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’। আগামী ৪ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রিয় এসব শিক্ষককে সম্মাননা দেওয়া হবে।
রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে গতকাল শনিবার এই অনুষ্ঠানের সূচনা পর্ব হয়ে গেল। সেখানে শিক্ষক থেকে শুরু করে সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা উপস্থিত হয়ে তাঁদের প্রিয় শিক্ষককে স্মরণ করেছেন। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কেউ কেউ হয়েছেন আবেগপ্রবণ। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনেন প্রিয় শিক্ষকদের গল্প।
অনুষ্ঠানের শুরুটাও হয় শিক্ষকদের নিয়েই। প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে গড়া পদ্মাপাড়ের (রাজশাহীর চরখিদিরপুর) আলোর পাঠশালা নিয়ে তৈরি একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। আলোর পাঠশালার শিক্ষকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে কীভাবে অবহেলিত শিশুদের পাঠদান করেন, সেটি দেখানো হয় প্রামাণ্যচিত্রে।
এরপর প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির প্রধান মুনির হাসান ‘আইপিডিসি-প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা’র বিষয়বস্তু তুলে ধরেন। নিয়মানুযায়ী মনোনীত শিক্ষক ও মনোনয়নকারীকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। মনোনীত শিক্ষকদের বয়স কমপক্ষে ৪০ বছর হতে হবে। তিনি অবসরপ্রাপ্ত বা কর্মরত হতে পারবেন। একজন মনোনয়নকারী সর্বোচ্চ তিনজনের মনোনয়ন জমা দিতে পারবেন। মনোনয়নকারীর বয়স হতে হবে কমপক্ষে ১৮ বছর। অনলাইনে নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করা যাবে (www.prothomalo.com/priyoshikkhok) ওয়েব ঠিকানায়। এ ছাড়া ফরমটি ডাউনলোড করে সেটি পূরণ করে ডাকযোগে প্রথম আলোর ঠিকানায় পাঠানো যাবে। আজ রোববার শুরু হবে মনোনয়ন প্রক্রিয়া। চলবে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
স্মৃতিচারণায় প্রিয় শিক্ষকের গল্প
প্রিয় শিক্ষক সম্মাননা অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলতে গিয়ে নিজের শিক্ষকদের স্মৃতিচারণা করলেন আইপিডিসি ফিন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম। কর্মজীবনে আসার পরও তাঁর ক্যাডেট কলেজের একজন শিক্ষক কীভাবে তাঁকে সন্তান হিসেবে অবহিত করেন, তা-ও উঠে আসে তাঁর বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘এই সম্মাননার মাধ্যমে আমরা শিকড়ের কাছে যেতে পারি। সমাজে শিক্ষকদের যে সম্মান ও অবস্থান, সেটাকে সুদৃঢ় করতে না পারলে আমরা যে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে যাচ্ছি, সেখানে মনে হয় না খুব বেশি সফল হতে পারব।’ এই ধরনের উদ্যোগ বহুমাত্রিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান মমিনুল ইসলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে শিক্ষকতা করছেন। বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি নিজে যেমন হামিদ আলী নামের তাঁর এক প্রিয় শিক্ষকের কথা বললেন, তেমনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত তাঁর একাধিক শিক্ষার্থীও তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। সরকারের মুখের দিকে না তাকিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে সামাজিক শক্তি গড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী মাঠপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রিয় শিক্ষক মনোনয়নে কিছু পরামর্শ দেন। তিনি কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার উদাহরণ টেনে বলেন, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছে প্রিয় শিক্ষক তিনিই, যিনি তাদের আদর করেন, ভালোবাসেন। আর সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীদের যে স্যার, তাদের নিরাপদে স্কুলে আসতে-যেতে এবং ইভ টিজিং মোকাবিলায় বুদ্ধি-পরামর্শ দেন, তিনিই প্রিয় শিক্ষক। একই শ্রেণির ছেলেদের কাছে তিনিই প্রিয় শিক্ষক, যিনি খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ দেন। আবার কলেজশিক্ষার্থীরা বলেছে, প্রিয় শিক্ষক তিনিই, যিনি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির অপব্যবহার থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, সেটি বোঝান। এসব মতামত নিয়ে প্রিয় শিক্ষক মনোনয়নের পরামর্শ দেন তিনি।
শিক্ষার মানকে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এ বিষয়ে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে গুণগত শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য চৌধুরী মফিজুর রহমান। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের উপাচার্য এইচ এম জহিরুল হক বলেন, এখন শ্রেণিকক্ষে আর শিক্ষক নেই। তাই প্রিয় শিক্ষক পাওয়াই কঠিন হয়ে গেছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন স্যার জন উইলসন স্কুলের অধ্যক্ষ সাবরিনা শহীদ, টেন মিনিট স্কুলের উদ্যোক্তা আয়মান সাদিক প্রমুখ।
সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে প্রিয় শিক্ষকদের নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন অভিনয়শিল্পী আফসানা মিমি, বন্যা মির্জা, সজল, নিরব ও ইমন, সংগীতশিল্পী শারমীন সুলতানা সুমী, কনা ও কোনাল এবং নৃত্যশিল্পী পূজা সেনগুপ্ত। আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খোন্দকার সিদ্দিক-ই রব্বানী, রোবায়েত ফেরদৌস, রাশেদুর রহমান প্রমুখ।
ধন্যবাদ জ্ঞাপন বক্তৃতায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে যাঁদের কাছ থেকে শিখেছেন, তাঁদের স্মরণ করেন। তিনি বলেন, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শিক্ষকদের বাইরেও আরও অনেকের অবদান রয়েছে। প্রিয় শিক্ষক সম্মাননার শুভসূচনাকে ভালোর কাজের সূচনা বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলো সম্পাদক।
এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে গতকাল আইপিডিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম ও প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান নিজ নিজ পক্ষে চুক্তিতে সই করেন।