করোনার শুরুর দিকে ফুল কেনাবেচা শূন্যের কোঠায় নেমেছিল। মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে মাঠের ছাউনিও লন্ডভন্ড হয়ে যায়। কিন্তু ফুলচাষি সাজেদা বেগম দমে যাননি। আঘাত পেয়ে কাজের ক্ষমতা অনেকটা হারিয়ে ফেলা স্বামীকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমেছেন। সম্প্রতি যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীতে
করোনার শুরুর দিকে ফুল কেনাবেচা শূন্যের কোঠায় নেমেছিল। মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে মাঠের ছাউনিও লন্ডভন্ড হয়ে যায়। কিন্তু ফুলচাষি সাজেদা বেগম দমে যাননি। আঘাত পেয়ে কাজের ক্ষমতা অনেকটা হারিয়ে ফেলা স্বামীকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমেছেন। সম্প্রতি যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীতে

সমতার লড়াই আরও কঠিন হলো

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে। কিন্তু কোভিড-পূর্ব অবস্থায় ফিরতে কত দিন লাগবে, তা অনিশ্চিত। সবাই একসঙ্গে ভালো অবস্থানে যাবেন না। সে ক্ষেত্রেও ঝুঁকিতে থেকে যাচ্ছেন নারী।

দীর্ঘ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজস্ব উপার্জনের পথ তৈরি করেছে যেসব নারী, করোনা মহামারি তাঁদের সেই পথকে আবারও বন্ধুর করে তুলেছে। কাজের অনিশ্চয়তা, ব্যবসায় ক্ষতি, আয় কমে যাওয়া, পারিবারিক সহিংসতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগে বাল্যবিবাহের পাশাপাশি এই সময়ে নানা সামাজিক অপরাধের শিকারও হয়েছেন নারী। আবার সামনে থেকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কাজও করে যাচ্ছেন নারীরা। করোনার সময় ডিজিটাল পরিসরে সৃজনশীলতা নিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছেন অনেক নারী।    

বিচ্ছিন্নভাবে এমন মিশ্র চিত্র দেখা গেলেও দেশে পরিচালিত একাধিক জরিপে করোনাকালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর পিছিয়ে পড়ার চিত্রই তুলে ধরছে। এমনকি অর্থনীতিতে টিকে থাকা ও পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া হিসেবে সরকার যে আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে, তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে আছেন। ফলে অবস্থা পুনরুদ্ধারের যাত্রায় নারী পেছনে পড়ে যাচ্ছেন। সমতার লড়াইটা তো আরও কঠিন হয়ে পড়ছে নারীর জন্য।

এই অবস্থায় ‘নেতৃত্বে নারী: কোভিড-১৯ বিশ্বে সমতাপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়া’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ সোমবার ৮ মার্চ সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। যদিও নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে করোনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তবু চাপিয়ে দেওয়া প্রচলিত ধ্যানধারণা এবং সহিংসতামুক্ত একটি সমতাপূর্ণ আগামীই নারীরা চান।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, করোনা আঘাত হানার পর সবার আগে কাজ হারালেন নারী। আবার পুরুষেরা কাজ হারিয়ে বাসায় অবস্থানের পর অর্থনৈতিক চাপ থেকে পারিবারিক অশান্তি শুরু হলো এবং সেখানেও সহিংসতার শিকার হলেন নারী। পোশাক কারখানার মেয়েরা কাজ হারানোয় তাঁদের পরিবারের পুষ্টি ও কল্যাণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ। বাসায় বসে থাকা মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকে বাল্যবিবাহের শিকার হলো। এখন এই মেয়েদের অকালে গর্ভধারণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর একটা আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হয়েছে। কিন্তু কোভিড-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে কত দিন লাগবে, তা যেমন অনিশ্চিত, তেমনি সবাই একসঙ্গে ভালো অবস্থানে যাবেন, তা-ও সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রেও ঝুঁকিতে থেকে যাচ্ছেন নারী।

কাজে ফিরলেও উপার্জন কম

রাজধানীর ভাটারা থানার কুড়াতলী এলাকায় টিনশেডের একটি কক্ষে পরিবার নিয়ে ভাড়ায় থাকেন গৃহকর্মী সেলিনা বেগম। স্বামী মানিক মিয়া নির্মাণশ্রমিক। তাঁদের তিন সন্তান। সেলিনা প্রথম আলোকে জানান, করোনার শুরুতে তিনি কিশোরগঞ্জে গ্রামের বাড়ি চলে যান। বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়িতে অভাব। তাই জুনে ঢাকায় ফিরে আসেন। মাস তিনেক শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছেন। তিন মাসের ভাড়া বাকি। ঋণও হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে সেলিনা বলেন, স্বামী আগের সমান উপার্জনের কাজ ফিরে পেলেও তিনি পাননি। আগে তিনটি বাসায় কাজ করে মাসে ১০ হাজার টাকা পেতেন। সেপ্টেম্বরে দুটি বাসায় কাজে ডেকেছে, পান পাঁচ হাজার টাকা।

গত অক্টোবরে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ‘কোভিড-১৯ মহামারিতে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক শ্রম খাতের অবস্থা’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে জানায়, ফেব্রুয়ারিতে যে নারীর আয় প্রায় ৯ হাজার টাকা ছিল, তা জুনে কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার টাকায়। আগস্টে কিছুটা বেড়ে হয় প্রায় ৪ হাজার টাকা। আগের আয়ে ফেরার ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারী পিছিয়ে আছেন। এতে আরও বলা হয়, গত বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় আগস্টে নারীর আয় ৫৬ শতাংশ এবং পুরুষের আয় ৪৫ শতাংশ কম ছিল। টিকে থাকার লড়াইয়ে সরকারি বা ব্যক্তি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ নারীকে।

শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে দেশে মোট শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশ হচ্ছেন নারী। শ্রমে নিয়োজিত নারীর প্রায় ৯২ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কোভিডের কারণে সমতার লড়াই অনেক কঠিন হয়ে গেছে, এটা সত্য। যেসব নারী পারিবারিক টানাপোড়েন ছাপিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পথে যাত্রা করেছিলেন, কোভিডের কারণে তাঁদের সেই যাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ঘুরে দাঁড়ানো নির্ভর করে পুঁজির ওপর। যাঁদের পুঁজি নষ্ট হয়েছে, তাঁদের জন্য ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে গেছে। যেসব উদ্যোক্তা এক জায়গা থেকে পণ্য এনে আরেক জায়গায় বিক্রি করেন, তাঁরা তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের জন্য ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হচ্ছে।

৬১ শতাংশ নারী পোশাককর্মী কাজ হারিয়েছেন

ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় একটি পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন লতা বেগম (৪০)। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, করোনার শুরুতে ঠান্ডা-কাশি হলে তাঁকে ছুটি দিয়ে দেন মালিক। এপ্রিল মাসের ৯ হাজার ৩০০ টাকা বেতন দিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু আর চাকরিতে নেওয়া হয়নি। লতা বেগম বলেন, ‘অনেক কারখানায় কাজের জন্য গিয়েছি। কিন্তু “বয়স বেশি” বলে ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন গৃহকর্মীর কাজ করে টিকে আছি।’

করোনাকালে ৬০০ কারখানায় পরিচালিত সিপিডির জরিপ প্রতিবেদনে (অক্টোবরে প্রকাশিত) বলা হয়েছে, করোনার সময়ে কারখানাগুলো ৮ শতাংশ জনবল কমিয়েছে। দেশে মোট পোশাক কারখানা রয়েছে ৩ হাজার ১০০। পোশাক কারখানার ৫৩ শতাংশ নারী। তাই কাজ হারানোর মধ্যে নারীর হার বেশি ছিল, ৬১ শতাংশ। ৩১ শতাংশ কারখানায় নারী ও পুরুষের অনুপাতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ওই সব কারখানায় করোনার আগে নারী ৬২ শতাংশ ও পুরুষ ৩৮ শতাংশ ছিল। এখন নারী কর্মী ৫৭ ও পুরুষ ৪৩ শতাংশ।

গবেষণার বিষয়গুলো উল্লেখ করে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পোশাক কারখানায় কাজ হারিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ কর্মী। এই জরিপ এখন করলে চাকরি হারানোর সংখ্যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় কম হবে। কারণ, নতুন ক্রয় আদেশ আসছে। চাকরি হারানো অনেকেই কাজ ফিরে পেয়েছেন।

প্রণোদনার অর্থের ৫ শতাংশ নারীর

করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অন্তত ৫ শতাংশ বা ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এসএমই খাতে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রণোদনার ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী উদ্যোক্তারা পেয়েছেন প্রায় ৫ শতাংশ, ৬৩৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণ হওয়া ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মোট ঋণের মধ্যে প্রায় ৪ শতাংশ পেয়েছেন নারীরা।

অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেছেন, প্রণোদনার অর্থ পেতে বড় ও ছোট শিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যে বৈষম্য হয়েছে। আবার ছোট শিল্পে পুরুষের তুলনায় নারীরা প্রণোদনার অর্থ কম পেয়েছে। অর্থ দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংক পুরোনো ক্লায়েন্ট ছাড়া ঋণ সহজে দিতে চায় না। নারীদের আরও দিতে চায় না।

কোভিড পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশন ক্রেডিট হোলসেলিং কর্মসূচির আওতায় গত ৯ মাসে ২২ কোটি ২১ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে ২৮২ জনকে। এর মধ্যে নারী মাত্র ৫ জন। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়েছিল ১৯৫ জনকে। এর মধ্যে নারী ছিলেন ২৭ জন।

গত অক্টোবরে নারী উদ্যোক্তা ও কর্মীদের ওপর ব্র্যাকের পৃথক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭১ শতাংশের প্রণোদনা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। প্রণোদনা সম্পর্কে জানলেও ঋণ পেতে চেষ্টা করেছেন ৪৪ শতাংশ। বাকিরা ভোগান্তির ভয়ে যাননি। ৪৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া জানেন না। ৬৬ শতাংশ জানিয়েছেন, ব্যবসায়িক কোনো কাজে ব্যাংকের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেননি কখনো।

ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক কে এ এম মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, অনানুষ্ঠানিক খাতের বেশির ভাগ উদ্যোক্তার ট্রেড লাইসেন্স নেই। ফলে কাগজপত্র না থাকায় ব্যাংকের মাধ্যমে তারা ঋণ নিতে পারেনি। তিনি জানান, সরকার এখন ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ এনজিওর মাধ্যমে দেওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছে। এটা বাস্তবায়িত হলে ছোট ছোট নারী উদ্যোক্তা উপকৃত হবেন।