করোনার রোগী বাড়ছে, সব হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয়নি
দেশে সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা চালুর নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বর্তমানে রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে।
হাসপাতালগুলোর নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রগুলোর (আইসিইউ) শয্যাও ফাঁকা নেই। রাজধানীতে করোনার জন্য নির্ধারিত মহানগর হাসপাতাল এবং মাতৃ ও শিশু হাসপাতালে মাসখানেক আগে পাঁচ শয্যার আইসিইউ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। দুই সপ্তাহ আগে চালুর কথা থাকলেও গতকাল বুধবার পর্যন্ত আইসিইউ সুবিধা চালু হয়নি।
গতকাল পর্যন্ত দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৫৫ হাজার ১৪০ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১১ হাজার ৫৯০ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৪০ শতাংশের উপসর্গ থাকে মৃদু। মাঝারি মাত্রার উপসর্গ থাকে ৪০ শতাংশের। তীব্র উপসর্গ থাকে ১৫ শতাংশের। আর জটিল পরিস্থিতি দেখা যায় বাকি ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে। তীব্র উপসর্গ ও জটিল রোগীদের প্রায় সবার এবং মাঝারি উপসর্গ রয়েছে এমন অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
১ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা রয়েছে ১৩ হাজার ৯৬৪টি। এর মধ্যে আইসিইউ ৩৯৯টি এবং কিডনি ডায়ালাইসিস ১০৬টি। রাজধানীতে ৭ হাজার ২৫০টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে আইসিইউ ১৩৭টি, কিডনি ডায়ালাইসিস শয্যা ১০১টি।
রাজধানীতে গতকাল পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৯৯৮ জনের। রাজধানীতে শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সরকার ১৩টি হাসপাতাল নির্ধারণ করেছিল। এর মধ্যে একটি বেসরকারি হাসপাতাল সরকারের সঙ্গে চুক্তি থেকে সরে গেছে। আরেকটি হাসপাতালে শুধু করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা হচ্ছে।
এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি অংশে এবং বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নির্মিত অস্থায়ী আইসোলেশন সেন্টারেও করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
করোনার জন্য নির্ধারিত তিনটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে রোগী ভর্তির চাপ বাড়ছে। আইসিইউ ফাঁকা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে জটিল রোগীদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। আবার জটিল রোগী ভর্তি রাখলেও সাধারণ ওয়ার্ডে রাখতে হচ্ছে। আর চাপ বেশি হওয়ায় মৃদু ও মাঝারি উপসর্গের রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে একাধিক দিন জানানো হয়েছে, বাসায় থেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া রোগী হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মারা গেছেন। ফেসবুকে করোনা রোগী ও তাঁদের চিকিৎসা বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য বেশ কিছু গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপে করোনা রোগীর জন্য আইসিইউর ব্যবস্থা করতে অনেকেই সাহায্য চাইছেন।
করোনা শনাক্ত হয়ে গত মঙ্গলবার মুগদা হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন ৭৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। হার্টের সমস্যা থাকা ওই ব্যক্তিকে আইসিইউতে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। হাসপাতালটির আইসিইউতে শয্যা খালি না থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁর স্বজনেরা বিভিন্ন হাসপাতালে যোগাযোগ করেও আইসিইউর ব্যবস্থা করতে পারছিলেন না। ওই ব্যক্তির এক আত্মীয় প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক ঘণ্টা চেষ্টার পরে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে একটি আইসিইউর ব্যবস্থা করা যায়। রোগীকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ও অক্সিজেন সহায়তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে গত মঙ্গলবার দুটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন করা হবে। সদ্য অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হতে বেশ সময় লাগবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, সব হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা শুরু করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্রস্তুতির জন্য তারা কিছুটা সময় চেয়েছে। বেসরকারি কোনো কোনো হাসপাতাল চিকিৎসা শুরু করেছে। যারা শুরু করেনি, তারাও শিগগির শুরু করবে।
>আইসিইউ ফাঁকা না থাকায় জটিল রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মৃদু ও মাঝারি উপসর্গের রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে না।
সব হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা শুরু হয়নি
করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে গত ২৪ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশনা জারি করে। তাতে বলা হয়, ৫০ শয্যা বা তার বেশি শয্যাবিশিষ্ট সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে। ওই নির্দেশনার পর ১১ দিন পেরোলেও সব হাসপাতাল, ক্লিনিকে করোনা চিকিৎসা শুরু হয়নি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে সব হাসপাতালকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোভিড রোগীদের চিকিৎসা শুরু করা কিছুটা সময়সাপেক্ষ। জুনের শেষ নাগাদ সব হাসপাতালে করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে রাজধানীর দুটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা বলেন, করোনা রোগীদের শয্যাবিন্যাস সাধারণ রোগীদের থেকে আলাদা। প্রত্যেক শয্যার মধ্যে নির্ধারিত দূরত্ব রাখতে হয়। নন-কোভিড রোগীদের জন্য পৃথক তলায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের হাসপাতালে চলাচলের পথও আলাদা করতে হয়। এসব কিছু করতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন।
তবে সরকারের নির্দেশনার পর কিছু বেসরকারি হাসপাতাল সীমিত পরিসরে করোনা ইউনিট চালু করেছে। রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৫ শয্যার করোনা আইসোলেশন ইউনিট চালু করা হয়েছে। হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, সাতটি আইসিইউসহ করোনা ইউনিট করা হয়েছে।
নির্ধারিত হাসপাতালে রোগীর চাপ
বেসরকারি সাজিদা ফাউন্ডেশন হাসপাতালে গতকাল বুধবার ৪৫ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এই হাসপাতালে আইসিইউ রয়েছে চারটি। প্রতিটিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক ওবায়দুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আইসিইউ লাগবে এমন কোনো রোগী এলে ভর্তি করার সুযোগ নেই। হাসপাতালের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্য হাসপাতালগুলো এগিয়ে না এলে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল ২৫০ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। হাসপাতালটির ১০টি আইসিইউ শয্যার কোনোটিই খালি ছিল না। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি আইসিইউতে রোগী আছেন। হাসপাতালে ভর্তি অন্য কোভিড রোগীদের মধ্যে কারও আইসিইউ প্রয়োজন হলে বিপদে পড়তে হচ্ছে। তিনি মনে করেন, সব হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে কি না, সেই বিষয়টি সরকারের জোরালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা হাসপাতাল ও মুগদা হাসপাতালের ৬৩টি আইসিইউর প্রতিটিতে সার্বক্ষণিক রোগী থাকছে বলে জানা গেছে। সাধারণ শয্যাগুলোতেও রোগী ভর্তি। একই অবস্থা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও।
আইসিইউ চালু হয়নি
মহানগর জেনারেল হাসপাতালে গতকাল ৫১ জন ও মিরপুরের লালকুঠিতে অবস্থিত মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতালে ৫০ জন করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন। হাসপাতাল দুটিতে আইসিইউ সুবিধা নেই। মাসখানেক আগে হাসপাতাল দুটিতে পাঁচ শয্যার আইসিইউ ইউনিট বসানোর কাজ শুরু হয়। গতকাল পর্যন্ত কোনোটিতেই আইসিইউ চালু করা যায়নি।
মহানগর হাসপাতালের পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, আইসিইউর কিছু আনুষঙ্গিক সামগ্রী ও দক্ষ লোকবলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আইসিইউ চালু হতে পারে। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতালের পরিচালক শামছুল করিমও জানান, আগামী সপ্তাহে আইসিইউ ইউনিট চালু হতে পারে।
রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই। তাই জটিল কোনো রোগীকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ ফিরোজ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, আইসিইউ ও ভেন্টিলেশন না থাকায় জটিল সমস্যা রয়েছে, এমন রোগীদের অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সরকার গঠিত করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, সব হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার সিদ্ধান্ত খুবই ভালো। তবে সব হাসপাতাল এটি পুরোপুরি পালন করছে না। এটি বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ যেমন রয়েছে, কিছু হাসপাতালের ইচ্ছারও ঘাটতি রয়েছে। সব হাসপাতালের নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে করোনা চিকিৎসায় এগিয়ে আসা উচিত।
মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, করোনা দেশে আইসিইউর সংকট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। করোনার জটিল রোগীদের অনেক ক্ষেত্রে আইসিইউর চেয়েও অক্সিজেন সরবরাহের প্রয়োজন বেশি হয়। এ জন্য হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহের ‘হাই ফ্লো নজেল ক্যানেলা’ যন্ত্র সরবরাহ করা প্রয়োজন। যত দ্রুত এটি সরবরাহ করা যাবে, তত তাড়াতাড়ি জটিল রোগীদের সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।