কোম্পানীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গেছে বন্যার পানিতে
কোম্পানীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গেছে বন্যার পানিতে

সরেজমিন

‘সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বন্যায়’

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার তেলিখাল গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁর বাড়িতে হাঁটুসমান পানি ছিল। সেটি কোমরসমান হতে সময় লাগেনি। নিজের নৌকা চুরি যাওয়ায় ওই দিন সন্ধ্যায় অন্যের নৌকা জোগাড় করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চলে আসেন আশ্রয়কেন্দ্রে।

গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তেলিখাল উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা গেল, বিছানার চাদরে ভেজা চাল ছড়িয়ে দিয়ে শুকানোর চেষ্টা করছেন আনোয়ারা। তিনি বলেন, সকালে একটি নৌকা ধার করে দুই ছেলে
বাড়িতে গিয়েছিল। ঘরে পানির নিচ থেকে চালগুলো উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। এখন এগুলোই সম্বল।

এই আশ্রয়কেন্দ্রের আঙিনায় বেশ কিছু ভেজা ও কর্দমাক্ত কাপড় বন্যার পানিতে ধুয়ে নিচ্ছিলেন নেহেরু বেগম (৫০)। কিশোরী মেয়ে তায়েফাও সাহায্য করছিল। নেহেরু বলেন, বন্যায় সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঘরও চলে গেছে। সকালে কাপড়গুলো ঘরের পাশের গাছের ডালের সঙ্গে আটকানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। সম্বল বলতে এসব কাপড়, বিছানাপত্র আর কিছু হাঁড়িপাতিল। এর বাইরে পাঁচজনের সংসারে আর কিছুই নেই।

তেলিখাল উচ্চবিদ্যালয়ের পাশাপাশি তেলিখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দারুস সুন্নাহ মুহাম্মদিয়া মাদ্রাসাও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে তেলিখাল উচ্চবিদ্যালয়ে বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তিনতলা ভবনের নিচতলার আঙিনায় নয়টি গরু বাঁধা ছিল।

পাশে চারটি কক্ষে তিন গ্রাম থেকে আশ্রয় নেওয়া বাসিন্দারা। গরুগুলোর পাশে বিভিন্ন বয়সের মানুষ নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। দ্বিতীয় তলার কক্ষগুলোতেও মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তৃতীয় তলায় চারটি কক্ষ থাকলেও সেগুলোর দরজা–জানালা নেই। সেখানে টিন দিয়ে মানুষ থাকছেন।

এরই একটি কক্ষে উঠেছেন উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের লামা দেস্কি গ্রামের দেবেন্দ্র বিশ্বাস (৬০)। তিনি মাছ ধরে জীবিকা চালান। তবে ঘর ও জাল সব ভেসে গেছে বন্যায়। তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। সবাই বন্যার পানিই পান করছেন। সে সঙ্গে শৌচাগারের সুবিধাও নেই। শনিবার আশ্রয়কেন্দ্রেও হাঁটুসমান পানি ছিল। গতকাল সেই পানি নেমেছে।

সিলেট নগর থেকে বিমানবন্দর সড়ক হয়ে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়কের কিছু দূর এগিয়ে গেলে দুই পাশে কেবল পানিই চোখে পড়ে। সদর উপজেলার ছালিয়ার পর গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর বাজার। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্যার পানির কারণে সালুটিকর-কোম্পানীগঞ্জ মহাসড়ক বিচ্ছিন্ন ছিল। পানি নামতে শুরু করায় সীমিত পরিসরে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে দুটি স্থানে সড়কের ওপর দিয়ে এখনো প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ঝুঁকি নিয়েই অনেক যানবাহন এ সড়ক দিয়ে চলছে।

সালুটিকর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পর কোম্পানীগঞ্জের বর্ণি এলাকা। সেখানে প্রায় ২০০ মিটার সড়ক দিয়ে প্রবল স্রোতে পানি নামছে। তবু যানবাহন চলছে। নৌকায় করে বর্ণি হাওর দিয়ে যেতে হয় তেলিখাল গ্রাম। পথে বেশ কয়েকটি বাড়িঘর পড়ে। যার সব কটিই তলিয়ে গেছে। অনেক ঘরের বেড়া, চালা নেই। এসব বাড়ির বাসিন্দারা চলে গেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে।

বর্ণি গ্রামে নিজ বাড়ি দেখতে নৌকায় যাচ্ছিলেন সোলেমান মিয়া (৩৫)। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার ঘরে বুকসমান পানি ছিল। পরে ঘরের মালামাল খাট ও পালঙ্কের ওপর তোলে নৌকায় করে বের হতে হয়েছে। ১৪ জন বাসিন্দা নৌকায় ভেসে আশ্রয় নিয়েছিলেন সালুটিকর বাজারে। এ সময় খাওয়াদাওয়ার বেশি কষ্ট হয়েছে। প্রতি বেলা এক কেজি করে চাল কিনে খেয়েছেন।

তেলিখাল থেকে সড়কপথে প্রায় ৯ কিলোমিটার পর কোম্পানীগঞ্জ থানার বাজার। এই সড়কের দুই ধারে কিছু দূর পর তিনটি ট্রাক পানিতে উল্টে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সেতুগুলোতে বস্তা দিয়ে ছাউনির মতো বানিয়ে গরু রাখা হয়েছে। থানার বাজারে সড়কের পাশে দেখা গেল কাঁঠাল কেনা-বেচার চিত্র।

থানাবাজার থেকে নৌকা নিয়ে উপজেলা পরিষদ, কোম্পানীগঞ্জ থানা, থানাবাজার টিঅ্যান্ডটি রোড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ধলাই নদের পানি উপচে বাজারসহ আশপাশের এলাকায় চার থেকে পাঁচ ফুট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। থানাবাজার টিঅ্যান্ডটি রোডের সব দোকানপাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। থানা প্রাঙ্গণও প্রায় চার ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। উপজেলা পরিষদেরও একই অবস্থা। ওই এলাকার নলকূপগুলোও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদসহ আশপাশের এলাকায় যাতায়াতের এখন একমাত্র মাধ্যম নৌকা। উপজেলাটি এখনো বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন, মাঝেমধ্যে পাওয়া যায় মুঠোফোন নেটওয়ার্ক।

কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়কের পাশেই করা হয়েছে নৌকার ঘাট। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে গন্তব্যে যাওয়া–আসা করতে দেখা গেছে স্থানীয় লোকজনকে। কোম্পানীগঞ্জ বাজার এলাকার সব কটি ঘর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। দুই থেকে তিনতলার ভবনগুলোর বাসিন্দারা নিচতলা থেকে ওপরের তলায় বসবাস করছেন।

থানা বাজারের একটি ভবনের নিচে আশ্রয় নিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে নিচ্ছিলেন আয়েশা বেগম (৪৮) ও হালিমা বেগম (২৬)। তাঁরা এক সপ্তাহ ধরে ঘরছাড়া বলে জানিয়েছেন। ওই ভবনে আশ্রয় নিলেও কোনো সহযোগিতা পাননি বলে জানান তাঁরা।

বেলা দুইটার দিকে কোম্পানীগঞ্জ থানা সদরের পথ দিয়ে ফেরার পথে দেখা গেল, কয়েকজন যুবক একটি নৌকায় বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য প্রায় ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার নিয়ে যাচ্ছেন।