>আগা খান পুরস্কারজয়ী স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছেন নবীন স্থপতি ফাতিহা পলিন
ধানমন্ডি লেকের পাড়ে সবুজে ঘেরা ছোট্ট অফিস আরবানা। সেখানে একমনে কাজ করে চলেছেন স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। দেশের ঐতিহ্য, দেশজ উপকরণ আর যে জায়গাটায় প্রকল্পটি হবে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ নিয়ে ভাবনা থেকে শুরু হয়েছে পরিকল্পনা। তারপর চলেছে মডেল বানিয়ে কাটাকুটি। অসংখ্য স্টাডি মডেল ছড়িয়ে আছে অফিসময়। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। সহকর্মীদের সঙ্গে ভীষণ আন্তরিক। এ কারণে সবাই নিজের প্রতিষ্ঠানের মতোই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন। নতুন কেউ যোগ দিলে মজার একটা নিয়ম পালন করতে হয়। নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে হয় সবাইকে। কাশেফ নিজে রান্না করতে ভালোবাসেন। মাঝেমধ্যে নিজেই করেন দারুণ সব আয়োজন। হয়তো তাই এই ব্যতিক্রমী নিয়ম। অন্য সময় স্থাপত্যভাবনা নিয়েই ব্যস্ত। চিন্তার গভীরে গেলে ভুলে যান বাহ্যিক সবকিছু। একের পর এক ভাবনায় ধরা দেয় অনিন্দ্য স্থাপত্যশৈলী।
একক বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, অফিস কমপ্লেক্স, হাসপাতাল, মসজিদ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিচিত্র ধরনের কাজ করেছেন। বরাবরই ছিল মৌলিক কিছু করার প্রয়াস। তাই সমাদৃত হয়েছেন বহুবার। গাইবান্ধায় অবস্থিত ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের জন্য ২০১৬ সালে জিতে নিয়েছেন পৃথিবীখ্যাত ‘আগা খান পুরস্কার’। এমনকি এর আগে আগা খান পুরস্কারের মনোনয়নও পেয়েছেন দুবার—স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমের সঙ্গে যৌথভাবে করা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘরের জন্য ২০০৪ সালে এবং চট্টগ্রামের নিভৃত গ্রামে করা চাঁদগাঁও মসজিদের জন্য ২০১০ সালে।
কাশেফ একসময় ছিলেন স্থিরচিত্রের অনুরাগী। একক প্রদর্শনী করেছেন সাতটি। স্থাপত্যে আগা খান পুরস্কার ছাড়াও ২০১২ সালে পেয়েছেন আর্কিটেকচারাল রিভিউ অ্যাওয়ার্ড। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে অ্যারাউন্ড ঢাকা (২০০৪), প্লট নাম্বার ফিফটি সিক্স (২০০৯) ও দি নাইট অব ফিফটিন নভেম্বর (২০১১) উল্লেখযোগ্য।
আগা খান পুরস্কার পাওয়া ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি মূলত নদীভাঙনকবলিত মানুষজন নিয়ে কাজ করে থাকে। তাই গাইবান্ধা-বালাসি সড়ক থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে কাঞ্ছিপাড়ায় প্রায় ৮ বিঘা জমিতে এর কার্যালয় নকশা করার প্রস্তাব দেওয়া হলে কাশেফ ভিন্ন রকম করে ভাবলেন। তিনি দেখলেন, জায়গাটা রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা নিচে। মাটি ভরাট করে রাস্তার সমান উঁচু করতেই বাজেটের বেশিটা খরচ হয়ে যাবে। তা ছাড়া ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার একটি সেবামূলক সংস্থা। স্থানীয় মানুষজনের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থার লোকজনেরও এখানে আনাগোনা থাকবে। সবার থাকা-খাওয়া ও চলাচলের উপযোগিতাও জরুরি।
সবকিছু ভেবেচিন্তে কাশেফ মহাস্থানগড়ের প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের ধারণায় এর পরিকল্পনা করলেন। বন্যার পানি আটকাতে চারদিকে দেওয়া হলো বাঁধ। ৩২ হাজার বর্গফুট আয়তনের ভবনে রাখা হলো ১০০ জন ধারণক্ষমতার দুটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র (যার একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত), ২৪টি আবাসিক কক্ষ (যার ৫টি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত) এবং একসঙ্গে ৭০ জনের খাওয়ার মতো ব্যবস্থা। এ ছাড়া রইল পাঠাগার, খেলাধুলার ব্যবস্থা আর পানিনিষ্কাশনের পাঁচটি নালা।
বিশাল আয়তনের এই ভবনটি কিন্তু একেবারেই বদ্ধ বলে মনে হয় না। পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের প্রবাহ আর ভূমি সমতলে প্রসারিত গড়ন একে দিয়েছে আধুনিক অথচ সম্পূর্ণ দেশজ এক আভিজাত্য। একেকটি ব্লক যেন একেকটি গ্রামীণ বাড়ি। গ্রামীণ বাড়ির মতো অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ উঠোন আর বারান্দা দিয়ে ব্লকগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত।
রাস্তা থেকে কিন্তু এতসব আয়োজনের কিছুই চোখে পড়ে না। মাটির সমতলে থাকায় চোখে পড়ে শুধু সবুজ ঘাসে ঢাকা ছাদটুকু। বাকি সবটা মিলেমিশে থাকে প্রকৃতির গভীরে। পরিবেশ আর প্রতিবেশের সঙ্গে এই অপূর্ব যোগের ফলেই কাশেফের এই স্থাপনাটি পেছনে ফেলে দিয়েছে ৩৮৪টি আন্তর্জাতিক প্রকল্প।
সবুজ বাংলার এই অপূর্ব স্থাপনা দিয়ে কাশেফ বাংলাদেশে বয়ে এনেছেন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র থেকে অকুণ্ঠ প্রশংসা আর বিরল সম্মান।