বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) সংশোধিত সংস্করণ দ্রুত চূড়ান্ত করে প্রকাশের তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। কয়েক বছর পরপর বিল্ডিং কোড সংশোধন করে যুগোপযোগী রাখারও পরামর্শ দিলেন তাঁরা।
বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, ২৬ বছরের পুরোনো বিল্ডিং কোড দিয়ে দেশ চলছে, সেটিও ঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। ফলে বাড়ির মালিক থেকে শুরু করে আশপাশের মানুষ ও শহর—সব পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি বানানো সবার জন্যই মঙ্গলজনক।
গতকাল বুধবার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো আয়োজিত ‘বিল্ডিং কোড প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। আয়োজনে সহযোগী হিসেবে ছিল ইন্টারন্যাশনাল কোড কাউন্সিল, স্মার্ট ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এসডিই) লিমিটেড ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
বৈঠকে জাতীয় অধ্যাপক ও এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, বিএনবিসি সারা দেশের জন্য। তাই এর প্রয়োগ হতে হবে সারা দেশে। শুধু ঢাকায় এর প্রয়োগ সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। ছোট শহরেও এখন বহুতল ভবন হচ্ছে। তিনি বলেন, চূড়ান্তকরণের অপেক্ষায় থাকা বিএনবিসি-২০১৭ প্রকাশের পর মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এর বাস্তবায়ন। এ জন্য তিনি ‘বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি’ গঠনের তাগিদ দেন। পাশাপাশি ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ব্যবহার বা বসবাস সনদ) আছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য ভবনের মূল ফটকে কিউআর কোড লাগানোর পরামর্শ দেন।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) ও আরবান রিজিলিয়েন্স প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবদুল লতিফ হেলালী বলেন, রাজউকের আওতাভুক্ত এলাকায় ভবন নির্মাণ অনুমোদনের বিষয়টি তাঁর প্রকল্পের আওতায় পুরোপুরি অনলাইনভিত্তিক করা হবে। পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় বিএনবিসি বাস্তবায়ন এবং নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নসংক্রান্ত কর্মকৌশল ঠিক করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে রাজউকের আরবান রিজিলিয়েন্স প্রকল্পের টিম লিডার (এস-৯) সত্যেন ঘোষ বলেন, ১৯৯৩ সালের (২০০৬ সালে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ) বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করা হলেও বর্তমান অবস্থার চেয়ে অনেক উন্নতি হতো। কোডের বাস্তবায়ন বড় সমস্যা।
স্থপতিরা একধরনের নকশা তৈরি করে দেন আর ভবন হয় অন্য রকম। এর কারণ এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে গোলটেবিলে নগর গবেষণা কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সালমা এ শাফি বলেন, ঢাকায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথমে প্ল্যান পাস হয়, পরে ভবনের স্থাপত্য নকশা পাস হয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো ঠিকভাবে কাজ করে না। এর ফলে ১৪ তলার ভবন ১৮ তলা হয়।
সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ২০০৮ সালের বিধিমালা অনুসরণ করা হয়। আর সারা দেশে ১৯৯৬ সালের বিধিমালা অনুসরণ করা হয়। ঢাকার বাইরে বহু জায়গার পেশাদার ব্যক্তিরা জানেনই না যে তাঁদের জন্য কোন বিধিমালা প্রযোজ্য।
সাধারণ মানুষের বিল্ডিং কোড না মানার কারণ সম্পর্কে গোলটেবিলে বক্তব্য দেন বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়া লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান। তিনি দাবি করেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করে। অন্যদের না মানার পেছনে তিনি দুটি কারণের কথা উল্লেখ করেন। একটি হচ্ছে, বিল্ডিং কোড মানলে যে নিরাপত্তার সুবিধা পাওয়া যাবে, সে বিষয়টি অনেকেই জানেন না। অন্যটি হচ্ছে, অনেকেই মনে করেন, এটি না মেনে বাড়িঘর করলে খরচ কমবে। তাঁর পরামর্শ, আবাসন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যারা বিল্ডিং কোড মানবে, তাদের জন্য র্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সিনিয়র ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট স্বর্ণা কাজী তাঁর বক্তব্যে দুর্যোগ মোকাবিলায় আরবান রিজিলিয়েন্স প্রকল্প এবং এই প্রকল্পের প্রেক্ষাপট হিসেবে রানা প্লাজা ধসের ঘটনাটি উল্লেখ করেন।
গোলটেবিলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খান মাহমুদ আমানত বিএনবিসি বাস্তবায়নে জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রতি জোর দেন।
রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি ও বিল্ডিং ফর ফিউচার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীরুল হক প্রবাল তাঁর বক্তব্যে ভবনের ব্যবহার বা বসবাস সনদ দেওয়ার সঙ্গে রাজউকের সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাঁর মতে, রাজউক নিজেই উন্নয়নমূলক কাজ করে। তাই এই সংস্থার পক্ষে তদারক সম্ভব নয়।
বিএনবিসি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণ সম্পর্কে ক্রিয়েটো ডিজাইন রিসার্চ ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট সুমায়া ইসলাম বলেন, শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে গিয়ে দেখা যায়, দুটির মধ্যে বিস্তর ফারাক। এটি পূরণ হতেই অনেক সময় লাগে। তখন এই পেশায় জ্যেষ্ঠদের অনুসরণ করেন নবীনেরা। জ্যেষ্ঠরা বিএনবিসি অনুসরণ করলে নবীনেরাও অনুসরণ করবেন।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি জালাল আহমেদ বলেন, বিএনবিসির নতুন সংস্করণ অনুমোদিত হলে এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সারা দেশের জন্য বিধিমালা তৈরি করতে হবে এবং সেটি প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে বিএনবিসির নতুন সংস্করণও কার্যকর হবে না।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহম্মদ খান বলেন, ‘আমাদের নগরায়ণ ও শিল্পায়ন অপরিকল্পিতভাবে হচ্ছে। দেখভাল করার কেউ নেই। ফলে ঝুঁকির মাত্রাও বাড়ছে।’
রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. এমদাদুল ইসলাম ১৯৫২ সালের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট সংশোধনের পরামর্শ দেন। তিনি আইনটি সংশোধন করে তাতে বিএনবিসির কোনো ধারা ভঙ্গ করলে কী শাস্তি দেওয়া যাবে, তা যুক্ত করতে বলেন। পাশাপাশি প্রতিবছর না হলেও দুই বছর পরপর বিএনবিসি সংশোধন (আপডেট) করতে বলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বিল্ডিং কোডের উপযোগিতা তুলে ধরেন এবং তাঁর ধন্যবাদ প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।