অনলাইনে সহিংসতার শিকার হন প্রায় ৫৩ শতাংশ নারী। শিশুদের সামনেও অনেক সময় বিপজ্জনক কনটেন্ট চলে আসে। আবার অনেকে জেনে–না জেনে অনলাইনে মিথ্যা তথ্য বা গুজব ছড়িয়ে থাকেন। এতে দাঙ্গা, প্রাণহানিসহ বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হতে পারে। অনলাইনে অসচেতন থাকার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়।
গতকাল শনিবার বিকেলে ‘সবার জন্য অনলাইনে স্বাধীনতা’ শীর্ষক মিডিয়া ক্যাফে অনুষ্ঠানে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, কিশোর আলো ও প্রথম আলো।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক এ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে আলোচকেরা বলেন, অনলাইন ব্যবহার ও অনলাইনে তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। নিজেদের সচেতনতার মাধ্যমে অনলাইন নিরাপদ করা গেলে অনেক সমস্যা এড়ানো সম্ভব।
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ক্যাম্পেইন ম্যানেজার সেমন্তী মঞ্জরী বলেন, ‘অনলাইনে মেয়েদের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা দেশে গত বছর এক জরিপ করেছিলাম। সেখানে দেখা যায়, প্রায় ৫৩ শতাংশ মেয়ে বলেছে, তারা অনলাইনে সহিংসতার শিকার হয়েছে।’
চলতি বছর বৈশ্বিকভাবে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল আরেকটি গবেষণা করে। সেই গবেষণার তথ্য তুলে ধরে সেমন্তী মঞ্জরী বলেন, প্রতি ১০ জন মেয়ের ৯ জন বলেছে, তারা অনলাইনে সহিংসতার শিকার হয়েছে। অনলাইনে ভুল তথ্য বা গুজবের কারণে তাদের জীবনে কোনো না কোনো ধরনের খারাপ প্রভাব পড়েছে। প্রতি পাঁচজনের একজন মেয়ে বলেছে, তারা শারীরিকভাবে অনিরাপদবোধ করে। ২৬ শতাংশের মতো বলেছে, তারা কথা বলতে ভয় পায় অনলাইনে। অনলাইনে ভুয়া তথ্য, শরীর নিয়ে ব্যঙ্গ, সৌন্দর্য নিয়ে ব্যঙ্গ—সবকিছুই মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
পুলিশের বিশেষ শাখার ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স (এসএস) মাহ্ফুজা লিজা বলেন, পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন নামে একটা ওয়েবপেজ চালু করা হয়েছিল গত বছর। সেটার প্রায় এক বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই সময়ে সেখানে ১৭ হাজার ৭৭০ জন অভিযোগ করেছেন। তাঁদের অধিকাংশই নারী। এর মধ্যে ৪৩ শতাংশ আবেদনই এসেছে ফেসবুক আইডি হ্যাক হওয়ার কারণে। আর ১৫ শতাংশ ব্ল্যাকমেল ও ১২ শতাংশ নানাভাবে হয়রান হওয়ার অভিযোগ করেন। অভিযোগ করে খুব কমসংখ্যক, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলে মনে করেন তিনি।
মাহ্ফুজা লিজা আরও বলেন, ‘অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নিই। তবে আমরা বেশি জোর দিচ্ছি সচেতনতার ওপর।’ তিনি মনে করেন, পরিবারের বড়দের উচিত ছোটদের জন্য নিরাপদ অনলাইনের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এ জন্য রেস্ট্রিক্টেড মোড বলে একটা অপশন থাকে ইউটিউবসহ প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে। এটা চালু থাকলে ১২ বছরের কম বয়সীদের জন্য উপযোগী নয় এমন কনটেন্ট দেখায় না। পাশাপাশি শিশুদের নজরদারি করা যে তারা কী দেখছে। অনলাইন নিরাপদ করলেই অনেক সমস্যা এড়ানো সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল বলেন, ‘এখন সময় এসেছে ভার্চ্যুয়াল জীবনে কীভাবে ভালো থাকতে পারি, সে সম্পর্কে সবার জানা। অনলাইনে ভালো থাকার জন্য ফেসবুক বা যেকোনো আইডির শক্তিশালী পাসওয়ার্ড দিতে হবে। কম্পিউটার বা যন্ত্র ব্যবহার করলে চলে আসার সময় সাইন আউট করে আসতে হবে। সেই সঙ্গে সিক্রেট মোড ব্যবহার করলে তথ্যগুলো থেকে যায় না। আবার যেখানে–সেখানে গিয়ে ওখানকার ওয়াইফাই ব্যবহার করা যাবে না। তাহলেও হ্যাক হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’ অ্যাপ বা গেম তৈরি করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে নিরাপদ অনলাইন ব্যবহার শেখানো যাবে বলেও মনে করেন লাফিফা জামাল।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের যুব প্রতিনিধি সাবাবা বলেন, অনলাইন–সংক্রান্ত সমস্যায় পড়লে অনেকে মা–বাবার কাছে বলতে ভয় পায়। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা গেলেও অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
এদিকে অনুষ্ঠানে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, ‘অনলাইনে আমরা অনেক সময় মিথ্যা তথ্য, গুজব—এগুলো দিয়ে ফেলি। এতে কেবল মেয়েদের নয়, সমাজ–রাষ্ট্রেরও ক্ষতি হতে পারে। তাই অনলাইনে কোনো কিছু পোস্ট করার আগে ১০০ বার ভাবা উচিত। কারণ, এটা একবার চলে গেলে মুছে ফেলা যায় না।’