সবার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে

২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশের কিশোর সাদাত রহমান। ‘সাইবার টিনস’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সাইবার বুলিং প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার কারণে তাকে পুরস্কারটি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংগঠন কিডস রাইটস। তার মুখোমুখি হয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথা বলছেন সাদাত রহমান সঙ্গে।
ছবি : দীপু মালাকার
প্রশ্ন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: তোমার পরিচিতি বলা হচ্ছে, সাইবার নিরাপত্তাকর্মী ংগঠক। এ ব্যাপারে তোমার ব্যাখ্যা কী?

সাদাত রহমান: ধন্যবাদ স্যার। আসলে আমি এত বড় কোনো সাইবার নিরাপত্তাকর্মী না। হয়তো উইকিপিডিয়ায় বড় করে দেখানো হয়েছে। তবে আমি সংগঠক।

আমি সংগঠন এবং সামাজিক কাজে জড়িত হই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে। তখন পটুয়াখালীতে থাকতাম। ডাক বিভাগে বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে আমরা বিভিন্ন জেলায় থেকেছি। তো পটুয়াখালী থেকে আব্বু সাতক্ষীরায় বদলি হলে আমরা সেখানে চলে যাই। পটুয়াখালীতে আমি যেমন স্কাউটিং করতাম, একইভাবে সাতক্ষীরায়ও করতাম। সাতক্ষীরাতেই প্রথম আলো বন্ধুসভার সঙ্গে জড়িত হই। পাশাপাশি অবসরে আইসিটি নিয়ে কাজ করতাম। যেমন, স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলমান-চিত্র বানানো, ফ্রিল্যান্সিং ইত্যাদি।

তারপর আব্বু নড়াইলে বদলি হলেন। আমরা যখন নড়াইলে এলাম তখন এখানকার লোকজনের আইসিটি নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। এখানে আমি নবম শ্রেণিতে ভর্তি হই। তখন রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয় রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের ওপর নির্যাতনের সংবাদগুলো। কীভাবে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি—এ নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করি। একজন শিক্ষকের সঙ্গেও কথা বলি। তখন স্যার বললেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তুলতে। তো আমরা একটি মানববন্ধন ও সাইকেল শোভাযাত্রা করি। প্রায় দেড় শ শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। এলাকার মানুষের মধ্যেও এটা ব্যাপক সাড়া জাগায়। তখন আমার মনে হলো, সমাজের যেসব সমস্যা আছে, তার বিরুদ্ধে যদি সংঘবদ্ধ হই তবে তো সমস্যা দূর করা যায়। এই চিন্তা থেকে ২০১৭ সালে আমি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘নড়াইল ভলান্টিয়ার্স’ প্রতিষ্ঠা করি।

নিজের ক্যামেরা আর বন্ধুদের মোবাইল ব্যবহার করে যৌন হয়রানিবিরোধী ভিডিও চিত্র বানাতে থাকি আমরা; সেসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে থাকি। এই কাজটি ইউএনডিপি থেকে স্বীকৃতি পায়। ইউএনডিপি আমাদের কিছু যন্ত্রপাতিও দেয়। আমাদের কাজের গতি আরও বেড়ে যায়।

প্রশ্ন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমরা জানি, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে একটি মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা তোমাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। এর পরই তুমি ‘সাইবার টিনস’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করো।

সাদাত রহমান: ২০১৯ সালে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার দশম শ্রেণির ছাত্রী রুকাইয়া রুপার আত্মহত্যার ঘটনাটি আমাকে খুব মর্মাহত করে। মেয়েটি তার ক্লাসের দলনেতা ছিল। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে কিছু বখাটে তাকে উত্ত্যক্ত করত। এর মধ্যে এক ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু সে রাজি হয়নি। পরে ওই বখাটে রূপার একটি ছবি এডিট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তার পরও মেয়েটি রাজি হয়নি। এবার ছেলেটি ছবি এডিট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে রূপা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। শেষে এ পরিস্থিতিতে কী করবে, বুঝতে না পেরে আত্মহত্যা করে।

প্রশ্ন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: সাইবার টিনসঅ্যাপে কী ধরনের প্রতিকার পাওয়া যায়?

সাদাত রহমান: রূপার মর্মান্তিক ঘটনার পর আমার মনে হলো, নড়াইলে যদি কোনো মেয়ে এই পরিস্থিতির শিকার হয়, তবে কীভাবে সে সমাধান পাবে। তখন আমি নড়াইলের পুলিশ সুপার মহোদয়, জেলা প্রশাসক স্যার, মাশরাফি ভাই (মাশরাফি বিন মুর্তজা)—সবাইকে প্রস্তাব দিলাম, আমরা একটি অ্যাপ বানাব, যার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা কোনো সমস্যায় পড়লে তা আমাদের জানাতে পারবে। তাদের সমস্যা যদি ছোট হয়, যেমন ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড উদ্ধার, আইডি ডিজেবল হয়ে যাওয়া—এমন ছোটখাটো টেকনিক্যাল সমস্যা আমরাই সমাধানের চেষ্টা করব। আর যদি তা অপরাধযোগ্য বা হয়রানিমূলক সমস্যা হয় তবে আমরা সেটা পুলিশ প্রশাসনকে জানাব। কিন্তু ভুক্তভোগীকে থানায় যেতে বাধ্য করা যাবে না; এবং তার সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমার এ কথায় পুলিশ সুপার স্যার রাজি হলেন।

তারপর একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে আমরা তার নাম দিলাম ‘সাইবার টিনস’। একই সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর সুফল নিয়ে আমরা প্রচারণাও চালালাম।

প্রশ্ন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমরা বিভিন্ন পত্রিকায় তোমার সাফল্যের সংবাদ পেয়েছি। তোমার বানানো অ্যাপটি কি সবাই ব্যবহার করতে পারবে?

সাদাত রহমান: আগে সবাই ব্যবহার করতে পারত। পুরস্কার পাওয়ার পর এটা আপাতত বন্ধ রেখেছি। কারণ, অ্যাপের উন্নয়নে কাজ চলছে। এখন শুধু জরুরি হলে ওয়েবসাইটে কিংবা আমার ফেসবুক পেজে অভিযোগ এলে গ্রহণ করি।

প্রশ্ন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কাজ শুরুর পর কোনো পরিবর্তন দেখতে পেয়েছ?

সাদাত রহমান: আগে এলাকার ছেলেরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে মেয়েদের মেসেজ দিয়ে হয়রানি বা বিশেষ কোনো মুহূর্তের ছবি আদান-প্রদান করত। কিন্তু সাইবার টিনস অ্যাপ বানানোর পর তারা দেখল যে যারা এমন করছে তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এরপর এ ধরনের সমস্যা কমতে শুরু করে। আসলে নড়াইলে আমরা অনেক বেশি সাড়া পেয়েছি। আটজনের মতো অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে পেরেছিলাম। তিন শর বেশি ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করেছি। এত সাড়া পাব ভাবিনি।

সাদাত রহমান

সাইবার বুলিং প্রতিরোধে ভূমিকা পালনকারী

জন্ম

১৪ মে ২০০৩, মাগুরা

পড়াশোনা

নড়াইল সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে

মাধ্যমিক (২০১৯), এ বছর নড়াইল আবদুল হাই সিটি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী

কর্মকাণ্ড

‘নড়াইল ভলান্টিয়ার্স’ প্রতিষ্ঠা (২০১৭)

কিশোরীদের যৌন নিপীড়নবিরোধী স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অপরাজিতা নির্মাণ (২০১৭)

‘সাইবার টিনস’ অ্যাপ তৈরি (২০১৯)

পুরস্কার
আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার (২০২০)

প্রশ্ন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: সাইবার বুলিং নিয়ে সমস্যায় পড়লে ভুক্তভোগী যদি তিন সংখ্যার কোনো বিশেষ নম্বরে ফোন করে তাহলে কি দ্রুত সমাধান পাওয়া যাবে?

সাদাত রহমান: নম্বর যদিও আমাদের আছে, কিন্তু এতে তেমন কাজ হবে বলে মনে হয় না। কিশোর-কিশোরীরা অপরিচিতকে ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সূত্রেই বন্ধু বানায়। আমরা কিন্তু প্রথমেই বার্তা আদান-প্রদান করি, ফোন করি না। তা ছাড়া কিশোর-কিশোরীরা সাধারণত অপরিচিত নম্বরে কল করে না। তারা যদি ফোন করে সাইবার টিনসকে জানাতে পারত, আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। এ জন্য সরকারি পর্যায়ে এবং আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক মহল থেকে কোনো অ্যাপ থাকলে ভালো হয়।

প্রশ্ন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: এসব সমস্যা প্রতিহত করতে একটি পন্থা তুমি তৈরি করেছ। দেশব্যাপীই সেবা ছড়িয়ে দিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

সাদাত রহমান: সবার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে। আপনি যদি কোনো ল্যাপটপ, টিভি বা এসি কেনেন, তবে এর সঙ্গে পণ্য ব্যবহারের নির্দেশিকাটিও দেখতে পাবেন। সেখানে হয়তো দেখবেন বজ্রপাতের সময় বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বলা হয়েছে। দেখুন, আমরা সবাইকে ইন্টারনেট পৌঁছে দিচ্ছি, কিন্তু কীভাবে ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে—তা নিয়ে কিছু বলছি না। তাই সচেতনতা না বাড়ালে এ সমস্যা বাড়বেই। এ প্রসঙ্গে আমি চারটি বিষয় চিহ্নিত করতে চাই—১.সচেতনতা, ২. সহমর্মিতা, ৩. কাউন্সেলিং বা পরামর্শ, ৪. ব্যবস্থা গ্রহণ বা অ্যাকশন।

২০১৯-এ আমরা যখন নড়াইলে কাজ করছিলাম, সে সময় সাতক্ষীরায় হয়রানির শিকার হয়ে বিউটি নামে আরেকটি মেয়ে আত্মহত্যা করে। রূপা মণ্ডল থানায় যেতে পারেনি। তবে বিউটি কিন্তু আত্মহত্যার আগে থানায় জিডি করেছিল। পুলিশ তাতে কোনো সাড়া দেয়নি। তাই কোনো উপায় না পেয়ে মেয়েটি আত্মহত্যা করে। ফলে সচেতনতার পাশাপাশি, ভুক্তভোগীর প্রতি সহমর্মিতা ও ব্যবস্থা গ্রহণের মানসিকতাও আমাদের থাকতে হবে।

প্রশ্ন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে তোমার মতামত কী?

সাদাত রহমান: রূপা ও বিউটি দুজনেই একই রকম সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। এরা কারও কাছে ব্যক্তিগত ছবি প্রকাশ করেনি। আসলে এসব সমস্যার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর বাস্তবতা বুঝে তবেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।

কিশোর-কিশোরীরা স্কুল-কোচিং ছাড়া আর কোথাও যেতে সাহস পায় না। আমরা টিভিতে পুলিশকে দেখি। জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষার সময় পরীক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শনে ম্যাজিস্ট্রেট এলে আমাদের ভয় দেখানো হয়, ‘স্যার আসছেন, কেউ কথা বলবে না’ বলে। ফলে আমাদের বয়সীদের মনে এঁদের সম্পর্কে ভীতির সঞ্চার হয়। তাঁদের আমরা বন্ধু ভাবতে পারি না। অ্যাপ তৈরি করে আমি যে অনেক বড় কিছু করেছি, তা নয়। তবে এই দুই পক্ষের মধ্যে একটা সেতু তৈরির চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: তোমাদেরসেইফ টিনেজার, সেইফ ইন্টারনেট কর্মসূচি নিয়ে কিছু বলো।

সাদাত রহমান: ‘সাইবার টিনস’-এর কাজ করার সময় আমরা কিছু সমস্যা দেখতে পাই। যখন দেখলাম অভিযোগ নেওয়ার পর, কাউন্সেলিং করার পরও এসব বন্ধ হচ্ছে না, তখন কিশোর-কিশোরীদের ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতন করতে আমরা এই কর্মসূচি শুরু করি।

প্রশ্ন

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: এসব কাজের ব্যাপারে তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

সাদাত রহমান: আমি নড়াইলে যে কাজটি করেছিলাম, এটা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চাই। আমাদের অ্যাপের উন্নয়নের কাজও এখন শেষের
দিকে। এ ব্যাপারে শিক্ষা ও আইসিটি মন্ত্রণালয় সহায়তা দিচ্ছে। দেশের প্রতিটি স্কুলে আইসিটি ক্লাব গড়ে তোলা হবে। যাতে স্কুল থেকেই এসব সমস্যার সমাধান করা যায়।