সড়কে চাঁদাবাজি দেখতে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক ১০ টনের একটি ট্রাকে চড়ে গত রোববার বগুড়ার মহাস্থান হাট থেকে ঢাকার শ্যামবাজারে আসেন।
মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি চলছেই। একসময় পথে পথে ট্রাক থামিয়ে চাঁদা আদায় করা হতো। মাঝে টোকেন বা কার্ড দিয়ে পুরো মাসের চাঁদা তুলে নেওয়া হতো। সেই ‘টোকেন প্রথা’ বদলেছে। সড়ক–মহাসড়কে এখন চাঁদাবাজি হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাসিক চুক্তির টাকা পরিশোধ করছেন ট্রাকমালিকেরা। পুলিশ ট্রাক আটকানোর পর মুঠোফোন নম্বরে ফোন দিলেই ট্রাক ছেড়ে দেওয়া হয়। কার্ড দিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়টি গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর কার্ডের বদলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাসিক চুক্তির টাকা নেওয়া হচ্ছে।
পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি দেখতে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক গত রোববার ১০ টনের একটি সবজির ট্রাকে চড়ে বসেন। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থান হাটের সবজির মোকাম থেকে ১৩ টন শসা, মুলা, বরবটি, পটোল ও করলা নিয়ে বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয় ট্রাকটি। ২২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ট্রাকটি পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে এসে থামে গত রোববার দিবাগত রাত আড়াইটায়।
সাভারের আগপর্যন্ত দৃশ্যত কোনো চাঁদাবাজি দেখা যায়নি। সাভার থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত একাধিক স্থানে রসিদ দিয়ে ট্রাক থেকে চাঁদা তুলতে দেখা গেছে।
এর আগে ৬ এপ্রিল প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক রাজশাহী থেকে সবজির ট্রাকে চড়ে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনিও সড়কে চাঁদাবাজির প্রায় একই চিত্র পেয়েছিলেন।
রোববার দুপুরে মহাস্থান হাটের সবজির মোকাম থেকে বেরিয়ে ট্রাকটি বেলা তিনটার দিকে বগুড়া শহরের দ্বিতীয় বাইপাস সড়কে পৌঁছাল। চালক জানালেন, শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা মোড়ে পণ্যবাহী ট্রাকে মাঝেমধ্যেই চাঁদা তোলা হয়। তবে এখন চাঁদাবাজি নেই। বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজায় পৌঁছার আগেই ট্রাকের চালক ও সহকারী জানালেন, অন্য সময় এখানে ট্রাক থামিয়ে পুলিশ চাঁদাবাজি করত। তবে রোজা শুরুর পর এখানে পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি অনেকটা কমে গেছে।
ট্রাক না থামানোর কারণ জানতে চাইলে চালক বললেন, মহাসড়কে পুলিশ যাতে ঝামেলা না করে, এ জন্য এক মাস আগেও মাসিক চুক্তিতে দুই হাজার টাকা চাঁদা পরিশোধ করে কার্ড নিতেন তাঁরা। সেই কার্ড দেখালেই পুলিশ ট্রাক ছেড়ে দিত। এখন সেই কার্ডও লাগে না। কার্ড দিয়ে চাঁদাবাজির বিষয়টি গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর কার্ডের বদলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাসিক চুক্তির টাকা নেওয়া হচ্ছে। এখন ‘ডিজিটালি চাঁদাবাজি’ চলে বলে মন্তব্য করলেন ট্রাকচালক।
কথায় কথায় চালক ‘মেসার্স কালীগঞ্জ ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি’ ও ‘পাখি ভাই’ লেখা ছাপানো দুটি কার্ড বের করে দিলেন। ছাপানো কার্ড দুটিতে ট্রাকের নম্বর ও ইস্যুর তারিখ লেখা। একটি কার্ডে মেসার্স কালীগঞ্জ ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির নাম, নম্বর ও ট্রাকের নম্বর দেওয়া। ‘পাখি ভাই’ লেখা কার্ডের অপর পাশে পাখি মটরসের দুটি নম্বরও দেওয়া আছে। ট্রাকের মালিক মাসিক চাঁদা পরিশোধের পর এই কার্ডগুলো হাতে পান ট্রাকের চালক। কিন্তু এখন এই কার্ডগুলোর ব্যবহার কম।
চালকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ট্রাক এগিয়ে চলল। রাত ১১টার দিকে সবজিবাহী ট্রাক পৌঁছাল গাজীপুরের কালিয়াকৈর বাজারে। রাত সাড়ে ১২টায় ঢাকা-সাভার মহাসড়কের পাশে গেন্ডা বাজারের মোহাম্মদীয়া কৃষিপণ্য পাইকারি মার্কেটে ট্রাকটি থামে। এখান থেকেই দৃশ্যত চাঁদাবাজি শুরু হয়। এক ব্যক্তি রসিদ দিয়ে ১০০ টাকা চাঁদা নিলেন। নাম প্রকাশ না করে ওই ব্যক্তি বললেন, তিনি সাভার পৌরসভার ইজারাদারের লোক।
রাত দেড়টার দিকে মিরপুর–১ নম্বর কাঁচাবাজারের দিকে এগিয়ে যেতেই পোশাক পরা দুই ব্যক্তি এগিয়ে এলেন। রসিদ এগিয়ে দিয়ে ৫০ টাকা চাঁদা দাবি করলেন। রসিদে গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোশেনের ইজারাদার রাফি ট্রেডার্সের নাম লেখা। মিরপুর কাঁচাবাজারে একটি আড়তে ২৫ বস্তা শসা নামানোর জন্য রাস্তার পাশে ট্রাক দাঁড়াতেই এক ব্যক্তি রসিদ ধরিয়ে দিয়ে ১৫০ টাকা চাঁদা নিলেন। এই রসিদে সুলতানুল আউলিয়া হযরত শাহ্ আলী বাগদাদী (রহ.) বাজারের ইজারাদার মেসার্স আদর এন্টারপ্রাইজের নাম লেখা দেখা গেল।
রাত আড়াইটার দিকে শ্যামবাজারের মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স নামে একটি আড়তে কয়েক টন শসা নামানোর জন্য ট্রাক দাঁড়াতেই চারজন রসিদ নিয়ে এসে দাঁড়ালেন।
রাত তিনটায় শ্যামবাজারে সবজি খালাস শেষে ট্রাক থেকে পুলিশের এক সদস্যকে ১০০ টাকা চাঁদা নিতে দেখা গেল। এ সময় ট্রাকচালক জিজ্ঞেস করলেন, কেন টাকা দিতে হবে? জবাবে পুলিশের ওই সদস্য ঝাঁজের সঙ্গে বললেন, ‘ব্যাটা, তোক পাহারা দিতে সারা রাত জাগতে হয়। আজ গাড়ি কম, ১০০ টেকাই দে।’
হিসাব কষে দেখা গেল, সাভার থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত চার টন শসা খালাস করতে গিয়ে ট্রাকচালককে ঘাটে ঘাটে রসিদের বিপরীতে ৫৫০ টাকা এবং পুলিশকে ১০০ টাকাসহ মোট ৬৫০ টাকা চাঁদা গুনতে হয়েছে। শ্যামবাজার থেকে সবজিবাহী ট্রাকের পরের গন্তব্য যাত্রাবাড়ী হয়ে সিলেট।
রোববার মহাস্থান থেকে সবজির ট্রাকে রওনা দেওয়ার সময় সেখানকার একজন ট্রাকমালিক ‘পাখি ভাই’ লেখা একটি কার্ড দেখিয়ে মাসিক দুই হাজার টাকা চাঁদা পরিশোধের কথা জানিয়েছিলেন। ‘পাখি ভাই’র হয়ে এই চাঁদা তুলেন মহাস্থান বাজারের শাহিন সরকার নামের এক ব্যক্তি।
কার্ডের সূত্র ধরে মহাস্থান বাজারেই ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সংগঠনের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা মিলল শাহিন সরকারের। তিনি নিজেকে ‘পাখি ভাই’র সুপারভাইজার পরিচয় দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, মহাস্থান বাজারে ৩০ জন ট্রাকমালিককে পাখি ভাইয়ের কার্ড দেওয়া আছে। প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকা আদায় হয় ৩০টি কার্ড থেকে। এর মধ্যে ২৫ হাজার টাকা তিনি নিজেই বেতন পান। বাকি টাকা পায় ‘পাখি ভাই’। তবে একটু ঝামেলার কারণে এ মাসে কার্ড দেওয়া বন্ধ রয়েছে বলে জানালেন তিনি।
রোববার মহাস্থান হাটে পাইকারিতে এক কেজি হাইব্রিড শসা বিক্রি হয়েছে সাড়ে সাত টাকায়। পাইকারিতে কাঁচা মরিচ ৪০ টাকা, বেগুন ৩০, করলা ৩০, বরবটি ২০, পটোল ৪০, ঝিঙা ৩০ ও পেঁপে ১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এক দিনের ব্যবধানে গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে খুচরা পর্যায়ে হাইব্রিড শসার দাম ছিল ৩০ টাকা। কাঁচা মরিচ ১০০, বেগুন ৮০, করলা ৬০, বরবটি ৬০, পটোল ৬০, ঝিঙা ৬০ ও পেঁপে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।